এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

কামাতুর শরীরে সিক্ত হলো নারী: পুরুষ সমাজ কি শুচিতার উর্দ্ধে?

 

পূবোর্ক্ত শিরোনামের শুরুতেই প্রশ্ন ছিল -নারীর মূল্য কোথায়? প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরতের এ প্রশ্নে উত্তর আমরা পাই হুমায়ুন আজাদের (২০০০) লেখায়। তার পূর্বে একটি কামাতুর শরীরের পৌরাণিক গল্পের নায়িকার প্রাসজ্গিক অবতারনা। একটি নারী। পাঁচ সন্তানের জননী। একটি প্রজনন অঙ্গের মালিক; যদিও প্রকৃত মালিক তার স্বামী জমদগ্নি। রেনুকা একটি শরীরও বটে। যে শরীরে আছে জীবন ও যৌবন কিন্তু এ দুয়ের মালিক তিনি নন তবে ক্ষমতা প্রয়োগ যন্ত্রের অংশ বটে। এ শরীরের একছত্র মালিক তার স্বামী কিন্তু পুনরুৎপাদন কিংবা জন্মহার নিয়ন্ত্রণ হবে নারীর শরীরের মাধ্যমেই, নিয়ন্ত্রক স্বামী। তাইতো পাঁচ পুত্র সন্তানের পরিশ্রমী রেনুকা যখন নদীতে স্নান করতে যান। তখন দেখতে পান যে, তার দেশের রাজা নদীর আরেক পাশে তার রানীদের সঙ্গে জল কেলী খেলছে। রাজা-রানীদের এই জল কেলীতে স্বভাবতঃই রেনুকা নিজেই কামাতুর হয়ে পড়েন, যা আমার-আপনার জন্যও প্রযোজ্য কারন-“চোখের দাবি মিটলে পরে তখন খোঁজে মন, তাই তো প্রভু সবার আগে রূপের” (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত/ মদনমহোৎসব) জীবন ও যৌবন ভরে উঠে রসে। শরীর সিক্ত হয়ে যায়। বিশেষ অঙ্গ ভিজতে থাকে। যাকে রাধার ভাষায় বলা হয়- অঙ্গের জ্বলুনি। রেনুকা কিন্তু এ অঙ্গের জ্বালা তার দেশের রাজা দ্বারা নিভায় না বা মনে মনে কামনা করেও না। কিন্তু ঋষি স্বামী জমদগ্নি, তাঁর ধ্যানের ক্ষমতা বলে বুঝতে পারে যে, রেনুকার শরীর কামার্ত হয়েছিল, ভিজে গিয়েছিল শরীরের বিশেষ অঙ্গ। রেনুকা তার যৌন শুচিতা হারিয়েছে, মনের অজান্তেই জড়িয়েছে পরকীয়ায়। হায়রে! পুরুষ রাজাটি জানতেই পারল না যে তাকে দেখে লোভাতুর হয়েছিল অন্য কেউ। অথচ পুরুষ সৃষ্টির অদ্যাবধি থেকে আজ পর্যন্ত দৃষ্টিতে আসা নারীকে পরখ করে দেখে যৌনতার চোখ দিয়ে। জড়িয়ে পড়ে কামনার পরকীয়ায়। সে জন্য কোন পুরুষের শাস্তি তো হয়নি বরং পুরুষ সেজেছে মহৎ! পরবর্তীতে পরকীয়ার মতো মহাপাপের জন্য পিতার আদেশে পরশুরাম তার নিজ মাতাকে কুড়াল দিয়ে হত্যা করেন। বাধ্য সন্তানকে পিতা পুরস্কৃত করাতে চাইলে, বুদ্ধিমান সন্তান পুনরায় মায়ের জীবন ফেরৎ চান। মহাতপস্বী ঋষি পিতা জমদগ্নি- পুনরায় যৌনশুচি মিলনের জন্য হোক বা সন্তানের মনস্কামনা পূরণার্থে হোক রেনুকাকে পুনঃজীবন দান করেন।

এ জাতীয় অন্য আরেকটি গল্পের অবতারনা করার পূর্বে এটা তো বলা যায় যে, পুরুষ নিজেকে বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে কখনোই আনেননি কিংবা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হোননি বা হতে চাননি। কারণ পুরুষ-বরাবরই যৌনতাকে উপভোগ করতে চেয়েছে নিজের মতো করে বিশুদ্ধতার মানদন্ডে আর শুচিতার একেবারেই উচ্চ মার্গীয়তায়। যার ফলে নারী পরিণত হয়েছে যোনি, যৌন বস্তু তথা কামের পরিতৃপ্তির উপকরনে। এখানে পুরুষের দ্বৈত আচরণ লক্ষ্য করার মতো যে, নিজের স্ত্রীকে শুচিতার মোড়কে ঢেকে রাখে, আবার নিজেই পরস্ত্রীকে চেখে দেখে। যেমনটা দেখি ইন্দ্রের বেলায়। ইন্দ্র, গৌতম মুনির স্ত্রী অহল্যার সাথে ছলনার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। ভোরে গৌতম মুনি আহ্নিক স্নানে গেলে, ইন্দ্র গৌতম মুনির বেশে সঙ্গম করেন। কেউ কেউ বলেন- ইন্দ্রকে অহল্যা চিনতে পেরেও সঙ্গমে সম্মত হোন। স্নান শেষে গৌতম মুনি ফিরলে বুঝতে পারেন এবং উভয়কে শাপান্ত করেন।যদিও কেউ কেউ (আহমেদ: ২০২০) একে ধর্ষণ বলেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই একে ধর্ষণ বলা যায়না। কেননা উভয়ের সম্মতিতে তা স্থাপিত হয়েছে বরং যে বিচারে আমরা রাধা কৃষ্ণের সম্পর্কের বিচার করতে বসেছি বরং এটা তাদের পূর্বপুরুষের ঘটনামাত্র। কারণ গৌতম মুনি অহল্যাকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলে “মার্জার চলে গিয়েছে।” এই মার্জার শব্দটির অর্থ “নিষিদ্ধ প্রেমিক”। কারণ ছদ্মরূপ চিনতে পেরেও তিনি সঙ্গমে সম্মত হোন।

তাহলে- শুচিতা থাকবে কোথায়? হালের ডেসটিনি কোম্পানীর গল্পের মতো- সবাই ক্রেতা আর বিক্রেতা; যেন একাকার। কিন্তু লাভের হদিশ নাই। কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রে এমনটা হলে মুশকিল নয়, মহামুশকিল হবে-আসান মিলবেনা কোথাও। যার দরুন-পুরুষ নারীকে নির্দেশ করে, নারীর স্বাতন্ত্র্য বোঝায় নিজের স্বার্থে তুলনা করে। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, নারীর যৌন অঙ্গই হচ্ছে সকল নেতিবাচক কর্মকান্ডের সূত্রপাত। নারী তার পরাজয় স্বীকার করে তার এই বিশেষ অঙ্গ বা যৌনতার কারনে অথবা পুনরৎপাদনের দরুন। তাই রাধা তার যৌনতাকে ব্যবহার করে তার স্বাধীনচেতার কর্মকথা অকপটে বলে গেলেও সমাজ-সংস্কারবাদীরা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ চাপিয়ে আমরা-কি নারীমুক্তিকে আটকিয়ে রাখিনি? আর এ সকল কারণে বলা যায় যে, নারীর কাছে পুরুষ যৌনতার বিশুদ্ধতা চায় কিন্তু নিজে? প্রশ্নটি অবান্তর। অথচ রাধা তা শুরু করেছিল অনেক আগেই, শ্বাশুড়ি, বর বা জামাই, ননদ পরিশেষে সমাজের রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে নারীমুক্তির কথা বলেছিল প্রকাশ্যেই, অকপটে। তাই রাধা গলায় সুর তোলে মাঠে ঘাটে গেয়ে উঠে-

“খুঁজে খুঁজে ফিরি সরানেরও ধারে,

কেষ্টাব্যাটা মোর, গেলো কোথায়?

এমন দিনে মোর পিরিতি লাগিল

কেষ্টো গরু চড়ায়।

ফাগুন দিনে আসি জলেতে নামিলাম

মন পড়ে থাকে পাড়ে।

বসন ফেলে রাখি, মনেতে ঢেউ লাগি

কেষ্টো, নেই কোন ধারে।

ঘরেতে ফিরিলাম, গতর খাটিয়ে

রাতের রং এ শরীরে 

পিরিতির চাঁদ উঠে, বাঁশীতে সুর নাই

কেষ্টো মরে ঘুমের ঘরে।

আমি খুঁজে ফিরি, আধারে বাদারে

পিরিতির জ্বরে, জ্বলে মোর

কোথায় গেলো মোর কৃষ্ণ কালারে

কোথায় গেলো বৃন্দাবন।”

(অনন্যা খেঁদার গাওয়া গান ইউটিউব লিংক থেকে নেওয়া)

(গীতিকার পাতাল ক্ষ্যাপা)

 

আমরা ধরতেই পারি রাধার এমন উচ্চারণ- সাহসী কণ্ঠস্বর। পরকীয়ার প্রেমের জন্য নারী বরাবরই এর শিকার। সকল বঞ্চনা ও গঞ্জনা নারীকেই সইতে হয়। ক্ষমতার আঁধারে নারী অসহায় জীব। পুরুষ বরাবরই সুবিধা ভোগী সাহিত্যে কিংবা ব্যক্তিজীবনে-পুরুষ ব্যাখ্যা করেছে নিজেকে নিজেরেই অঙ্গ বাঁচিয়ে। ফলে নারীর বিশেষ অঙ্গ ভিজলে রসিকতা করেছে পুরুষ; নারী শিক্ষিত হলেও আজো প্রতিবাদের ভাষা ক্ষীণ, মোলায়েম। কিন্তু সময়, যুগ ও পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় রাধার প্রতিবাদ উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। রাধা কৃষ্ণের কাছে খবর পাঠানোর জন্য দূতও নিয়োগ করে করুন সুরে বলে উঠে- “মাথার বেণী খুলে দিবো, তারে আইন্যা দে।” রাধার এমন সাহসী, প্রতিবাদী,  সমাজরে প্রতি ভ্রুকুটি নিক্ষেপ তথা পুরুষশাসিত সমাজরে প্রতি অভিশাপ। রাধার এমন ক্ষমতার ব্যবহারকে কেইট মিলেটের (১৯৬৯) “সেক্সুয়াল পলিটিক্স” এর দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। অথ্যাৎ যৌনতার সম্পর্ককে যে লৌকিক রাজনীতির দৃষ্টি কোণ থেকে দেখেছেন, সেখানে স্বামী, ডাকিনী শ্বাশুড়ি, ও নাগিনী ননদী থাকা সত্ত্বেও রাধা পরকীয়া প্রেমের স্বপক্ষে যে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় উচ্চারনে প্রেমিক প্রবর শ্যামের সাথে মিলনের অভিপ্রায় কি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ? যদি যুক্তির খাতিরে মেনে নেই, রাজনীতির মূলকথা-ক্ষমতা। যা নিয়ন্ত্রণে ও ভোগে একচ্ছত্র অধিপতি-পুরুষ। তাহলে তো বলতেই হয় আজকের নারীর ক্ষমতায়নের ঝাণ্ডা উত্তোলনের যাত্রার মহারথ উদ্বোধন করেছিল রাই বিনোদিনী। যে কিনা সেই পুরুষালি ক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শনে নিজস্ব বিশেষ অঙ্গের বর্ণনা করেছেন অনায়াসে যেখানেই নিহিত রয়েছে নারীমুক্তির; গ্রোথিত আছে শুচিতা বা সতীত্বের কীট। আজকের যুগের সকল নারীবাদী তত্ত্বগুলো অন্ততঃ তাই বলে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে নারী মুক্ত ছিল; গর্ভধারন, শ্রমবিভাজন কিংবা কৃষির প্রসার নারীকে বন্দিনী করে ফেলেছে। তাই  নারীর মুক্তি তব অঙ্গে ।  

 

 


 

যৌন শুচিতার অভাব পরকীয়ায়ঃ প্রশ্ন কেন?

    

নারীর মূল্য কোথায়?শরৎ চন্দ্রের এমন প্রশ্নের উত্তরে যে উত্তরটি মাথায় আসে- তা হলো নারীত্ব (শরৎ:২০০৮:৭)। এই নারীত্ব কোথায় পাওয়া যায়? যদিও শরৎ প্রশ্ন তুলেছেন- ”ইহার কোন মূল্য হয়না তাই এটা অমূল্য”। কারণ “নারীত্বের সাধারণ মূল্য ধার্য করিবে কি করিয়া” বলে পাঠকের মনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে শরৎ আপাততঃ নিরুত্তর। তবে, জল যেমন অপরিহার্য আমাদের জীবনে, তেমনি নারীর জীবনে নারীত্ব তেমন গুরুত্ব বলে তিনি মনে করেন। সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় গ্রন্থে-এই নারীত্বের জয় জয়কার এমনকি প্রকৃতির বেলায়। আমরা সবাই নারী চাই, যে নারী কেবলই আমার, সে রক্ষা করবে শুচিতা বা সতীত্ব। কিন্তু বলার ক্ষেত্রে বলছি- প্রেমের আসল মজা পরকীয়ায় বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি! ঠিক অনেকটা বিশ্বমঙ্গলের নাটকে বিধৃত কাহিনীর মতো। শরৎ চন্দ্রের ভাষায় (২০০৮:১৪) এ প্রসিদ্ধ নাটকে গৃহকর্তা নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে অতিথিকে বিমুখ করবেনা (কারণ শাস্ত্রে আছে সর্বস্ব দিয়াও অতিথিকে সংস্কার করিবে) বলে নিজের সহধর্মিনীকে লম্পট অতিথির শয্যায় প্রেরণ করে। পাছে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও অধর্মের কারণে যমদূতের হাতে মার খেতে হয়।

মহাভারতে এমন পরস্ত্রী সম্ভোগের গল্পের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। বলি রাজাও তার স্ত্রী দীর্ঘতমাকে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে অন্যের সহবাস করান। এরকম ঘটনাকে বিদ্যাতয়নিক চর্চায় বস্তুকামী বলে আখ্যা দেওয়া হয়, যারা নিজের স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গেঁ সহবাস করতে দিয়ে আনন্দ পান; যদিও মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটা মানসিক বৈকল্য। বিদ্যায়তনিক টেক্সট এর ভাষায় এদেরকে অসৎপতি (Cuckold) বলা হয়। আয়ান ঘোষ এমন পতি ছিলো কি না তা বলা যায় না নিঃসন্দেহে। তবে রাধা যৌনতার সম্পর্ক স্থাপনে যে বিপ্লবের সূচনা করেছেন, খ্রি.পূর্ব ৪০০ বছর আগে, নারী সমাজ তা ধরে রাখতে পারিনি বলা যায় বলিষ্টভাবে মাতৃত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে নারীর যে ঐতিহাসিক পরাজয়ের সূচনা হয়, তা যৌন স্বাধীনতা বিসর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায় (বাখোফেন, এঙ্গেলস, রেবতী প্রমূখ সমাজচিন্তাবিদদের লেখাসমূহ বিবেচনা করুন)

পৌরুষত্ব এমন এক শক্তি- যা নারীও তার অন্তরে ধারন করতে পারে। যার ফলে নারী হয়ে উঠে বিদ্রোহী, শক্তির আঁধার। পুনরৎপাদনের জন্য হোক কিংবা তার পৌরুষত্ব বিকাশের তরে সে তখন শূচিতার ধার ধরেনা। যা মনে করা হয় কেবলই নারীর জন্য। উদাহরণ, এমন একাধিক নারীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। রাধা ব্যতীত কুন্তী, অহল্যা, উল্লুপী, অম্বালিকা, অম্বা, শিখন্ডী সহ আরো অনেকে।দ্রৌপদীর যৌনতা ঐ সময় ও সমাজের জন্য লাগসই হলেও উলূপীর পরস্বামী সম্ভোগে সন্তান পুনরৎপাদনকে আপনি কি বলবেন?

মহাভারতে সমসাময়িককালে উলূপীর ন্যায় অনেক নারী পাওয়া যায়। যারা সাহিত্যের মাধ্যমে ঐ সময় ও সমাজের ছবি প্রতিনিধিত্ব করে কারণ সাহিত্য সমাজের দর্পন তো বটেই। এ সকল নারীর মাধ্যমে যৌন শুচিতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়যে, এটা কেবল নারী জন্য প্রযোজ্য বিষয় ছিলোনা যদিও কালক্রমে এটা নারীর কাছেই প্রত্যাশিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেটা ফ্রেডরিক এ্যাঙ্গেলস পরিবারের নামক সংস্থার বিবর্তনের মাধ্যমে খোলাসা করেছেন তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ- পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি  নামক গ্রণ্থে

যৌনতা বলতে আমরা যাই বুঝি না কেন- পরিবার নির্মাণে বা বির্নিমানে এর ভূমিকা মুখ্য এবং শরীর কেন্দ্রিক। হয়তো এ কারণেই ফুঁকো ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের নতুন নতুন বিষয় বস্তু খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছেন। যেমন- যৌনতা, শাস্তি ও উন্মাদনা (সুধীর: ২০১০:১৫) ফুঁকো মনে করেন- সেক্স এক বিশেষ ডিসকোর্স, যেখানে বিবাহের ধর্মীয় বা আইনী বাধ্যবাধকাতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্ঞাতি সম্পর্ক ও সম্পত্তি হস্তান্তরের নিয়মাবলী (সুধীর: ২০১০:১৬)। কিন্তু যৌন চর্চায় এ সকল নিয়মাবলী সকল সময় মেনে চলেনি, এমনকি রাধা-কৃষ্ণের যে সম্পর্ক তাতেও এর ব্যত্যয় পাওয়া যায় মহাভারতেও বিদ্যমান অপরাপর অন্যান্য যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। প্রশ্ন হলো যৌন সম্পর্ক স্থাপন কি দাম্পত্য কিংবা পরকীয়ায় শুচিতার দায়ভার কেন এককভাবে নারীর। এটা কি ক্ষমতা চর্চার ফলাফল না কি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থারই ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া, যা আজও বহমান আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

যে প্রতিক্রিয়ায় ফুঁকো উত্থাপিত অবদমনের প্রকল্পের (রিপ্রোসিভ হাইপো বিসিস)-টের/ইঙ্গিত পাই, যার অস্তিত্ব  অনেক আগেই মহাভারতের কাজে পাই। এ প্রকল্প যৌনতাকে নানাবিধ বাধা নিষেধ, নৈতিকতার বেড়াজালে অবদমিত করে রাখে, করে বিনির্মান। ফলে, এক জটিল ধারণা বা অভ্যাসের সৃষ্টি হয় যা- নানাবিধ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, অনুসন্ধান, কথাবার্তা, লেখার মাধ্যমে প্রকাশকারি বলে একে “ডিসকোর্স” ও ডিসকার্সিভ প্র্যাক্টিস বলতে পারি। যেটি যৌনশুচিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য,তবে শুধুই তার বিষয়বস্তু হবে নারী। ফলে যৌনভাবনায়ত্ত বিবর্তন ঘটে এবং এ ভাবনার কেন্দ্রমূলে থাকে শারীরিক মিলনকে কেন্দ্র করে। এমন দেহগত মিলনের যে স্থুল চিন্তা তার অতি প্রকটরূপ আমরা ভারতীয় ঐতিহ্যে দেখতে পাই এবং প্রাচীন মহাকাব্য পুরাণ শাস্ত্রে নারী পুরুষের কাম চরিতার্থ করবার প্রবণতা বড় রকমের বাড়াবাড়িও লক্ষ্য করি (সুধীর: ২০১০;আহমেদ: ২০২০)। এ রকম  বাড়াবাড়ি আমরা কেবল নারীর শরীরের নিয়েও পাই। দেখা যেত পারে পরবর্তী উপ-শিরোনামে--।


 

অঙ্গের জ্বলুনি ও বনমালি কিংবা বনমালি বিহনে অঙ্গের জ্বলুনি


 

“ভ্রমর কইয়ো গিয়া- শ্রী কৃষ্ণের বিচ্ছেদে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া” এমন গানের তাৎপর্য বিশ্লেষণের পূর্বে গানের লিপিকার সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ রাধা-কৃষ্ণের উপস্থিতি সংবলিত ফোক বা লোকায়ত সংক্রান্ত গান ও সুরের স্বীকৃত প্রদান না করার বড়রকমের বিতর্কও দেখা যায় (চৌধুরী:২০০০;নিউটন: ২০১৫)। এ গানের গীতিকার রাধারমন দত্তের (১৮৩৩-১৯১৫) জন্ম তৎকালীন শ্রীহট্ট বা হালের সিলেটে। এ  অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি 'ধর্ম ফাঁকর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে 'আনন্দ শাস্ত্রীনামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন বলে গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। আনন্দ শাস্ত্রীর প্রৌপুত্র নিধিপতি শাস্ত্রীর পুত্র ভানু নারায়ন। উক্ত ভানু নারায়নের চার পুত্রের মধ্যে রামচন্দ্র নারায়নের এক পুত্র ছিলেন প্রভাকর। বলা হয়ে থাকে যে, মুঘল সেনাপতি খোয়াজ উসমান দ্বারা ইটা রাজ্য অধিকৃত হলেএই রাজ বংশের লোকগণ পালিয়ে গিয়ে আশে পাশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় প্রভাকর দত্ত তার পিতার সাথে আলিসারকুল চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন বসবাস করার পর জগন্নাথপুর রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। কিছু দিন পর জগন্নাথপুর রাজ্যের তৎকালীন অধিপতি রাজা বিজয়সিংহের অনুমতিক্রমে প্রভাকর জগন্নাথপুরের নিকটস্থ কেশবপুর গ্রামে বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন। পরবর্তীতে রাজা বিজয় সিংহ প্রভাকরের পুত্র সম্ভুদাস দত্তকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অতপর বানিয়াচংয়ের রাজা গোবিন্দ খা বা হবিব খার সাথে বিবাদে জগন্নাথপুর রাজ বংশের বিপর্যয়ের কারণরাজআশ্রীত কর্মচারীরাও দৈন্য দশায় পতিত হন । এ সময় সম্ভুদাস দত্তের পুত্র রাধামাধব দত্ত অন্যের দ্বারস্থ না হয়েঅনন্যচিত্তে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। রাধামাধব দত্ত সংস্কৃত ভাষায় জয়দেবের বিখ্যাত গ্রন্থ 'গীত গোবিন্দবাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তার রচিত ভ্রমর গীতিকাভারত সাবিত্রীসূর্যব্রত পাঁচালিপদ্ম-পুরাণ ও কৃষ্ণলীলা গীতিকাব্য উল্লেখযোগ্য। এই প্রসিদ্ধ কবি রাধামাধব দত্তই ছিলেন রাধারমণ দত্তের পিতা।

কবি রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তার পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীতগৌবিন্দ এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা তাকেও প্রভাবিত করেছিল। ১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমণ পিতৃহারা হন এবং মা সুবর্ণা দেবীর কাছে বড় হতে থাকেন। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দ বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতার রচিত গ্রন্থ গুলো সে সময় তার জন্য পিতা আদর্শ হয়ে অন্তরে স্থান করে নেয়। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রচনা করেন অংখ্য বাউল গান । লিখেছেন কয়েকশ ধামাইল গান। জানা যায়সাধক রাধারমণ দত্ত ও মরমি কবি হাসন রাজার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। অন্তরের মিল ছিল খুব বেশি। তাদের মধ্য বিভিন্ন সময় পত্রালাপ হতো কবিতায়। 

 

 ফিরে আসি প্রাসঙ্গিক বনমালীতে। কে এই বনমালি? সোজা সাপটায় বলা যেতে পারে যে, দাপর যুগের ত্রাতা- কৃষ্ণ সর্বভারতীয় অঞ্চলে যখন অন্যায়-অবিচারে পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায় তখন অযোধ্যায় দেবকী ও বাসুদেবের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন ঐযুগের অবতার-কৃষ্ণ। ছোট বেলায় ডানপিটে, দুরন্ত বালক, মামার কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঝড়ের রাতে বাসুদেব অলৌকিক ক্ষমতার লীলা খেলায় বৃন্দাবনে যশোদার ঘরে রেখে আসেন। চৌদ্দ বছর পর্যন্ত যত লীলা খেলা–এই বৃন্দাবনে। যেখানে একই সময়ে  তথাকথিত ১৫ দিন পর জন্ম নেয় রাধা - প্রেম ও খেলার ঊভয়ের সাথী। এই রাধা-কৃষ্ণের রসায়ন নিয়ে যতো  প্রেম-কাহিনী আর গল্পে হয়েছে সবগুলোই প্রেমের মাহাত্ম্য বা জীবাত্মার বর্ণনা করা হয়েছে কেউ কেউ পরকীয়া প্রেমের এক নিদারুন আদর্শের উদাহরণ টেনে তুলে ধরেন। যুগে যুগে এ প্রেমের মাহাত্ম্য এতই বর্ণনা করা হয়েছে যে, এখন বলা হয় প্রেমের আসল মজা নাকি পরকীয়ায়। সমাজ ও সংস্কৃতিতে তাই এ ধরনের প্রেমের জয়-জয়কার বটে। ওই যে, ভালো লাগার নিজস্ব ধরনটুকু হতে হবে আপনার - আপনি কি করবেন- আপনার উত্তরের উপর নির্ভর করবে আপনার কর্ম ও কর্মের ফল?

এই শ্যাম-রাই, যাদের প্রেমের উপর বাংলার লোক সংস্কৃতি জগতে দু’টি বিখ্যাত গান পাওয়া যায়। সেই গান দুটোর আলোকে আজকের পরকীয়া প্রেমের শবচ্ছেদ করার একটি প্রয়াস মাত্র যা আমাকে ভালো লাগে এমন একটি প্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ মাত্র। যেমন- “বনমালি তুমি পর জনমে হইও রাধা।”  আর দ্বিতীয় সঙ্গীত খানা- “ভ্রমর কইয়ো গিয়া- শ্রী কৃষ্ণের বিচ্ছেদে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া

“বনমালি ..............পরজনমে হইও রাধা” আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যৌনতা সম্পর্কিত আলোচনা বাতুলতা মাত্র অথচ বাৎসায়ন এসংক্রান্ত আলোচনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ - খ্রিস্টাব্দ ২০০ সময়ে রচিত তাঁর কামসূত্র নামক  বিখ্যাত গ্রণ্থে। ধর্ম, অর্থের ন্যায় যৌনতাকে তিনি সমগুরুত্ব দিয়েছেন একটি সুস্থ জাতি বিনির্মানে। এ সম্পর্কিত আলোচনা মানেই এক ধরনের সুড়সুড়ি কারণ এ রকম শিরোনাম যে লেখার বিষয়বস্তু হতে পারে তা আমাদের চিন্তা-চেতনায় আসেনা মধ্যবিত্তের দার্শনিক চিন্তার দৈন্যতার কারনে। ভালোবাসা আর চিন্তার দৈন্যের কারণে একে অশ্লীল বা বিতর্কিত আমরা ভাবতেই পারি। কিন্তু সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে এ যৌনতা, প্রেম পরকীয়া (রায় ও অনন্যা: ১৪২৬বঙ্গাব্দ)। কিন্তু চিরন্তন এ সুড়সুড়ির অস্বীকার নয় বরং এতদ্‌বিষয়ে আলোচনা এখন বিশ্বায়নের যুগে প্রযোজ্যই বটে তা না হলে এ সংক্রান্ত ডিসকোর্স তৈরী হতো না বিদ্যাতয়নিক জ্ঞানকান্ডে (চৌধুরী:২০০০; নিউটন: ২০১৫) যদিও এসবের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। আছে লুকোচুরির খেলা ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রবাহে দেহকেন্দ্রিক সংযোজন,যেখানে পুরুষতান্ত্রিকতার নির্মম আঘাতে নারীকে করেছে ক্ষতবিক্ষত। যৌনতা ও প্রেম সম্পর্কিত আলোচনা বিষয়ে আমাদের তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এক বিবর্তনীয় চিত্র পাই বাঙালীর জীবনে রমনী গ্রণ্থেপ্রেম, কাম, শ্লীলতা, আর অশ্লীলতার- উদাহরণ সমেত বিস্তারিত আলোচনার ধারাবাহিকতা আমরা আত্মঘাতী বাঙ্গালী গ্রণ্থেও পাই।

ভদ্র সমাজে যৌনতা নীতিগত দিক হতে এ বিষয়টি সকল সময় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বর্জনীয় কিংবা অপাঙ্তেয় আলোচনা কারণ এটা নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনের একটি বড় বিনোদন। বিশেষত শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের মধ্যে অশ্লীল কথাবার্তা তাদের জীবনের অনুষঙ্গ। ভদ্রলোকেরা এ বিষয়ে সতর্ক এবং বহুক্ষেত্রেই নিজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (কবীর:২০১৪) এমন ভাবনার বহি:প্রকাশ আমরা চৌধুরীর (১৪২৩ বঙ্গাব্দ) লেখায় পাই প্রবলভাবে। অথচ এ সকল নিম্নবর্গীয় কন্ঠস্বরের উপস্থাপনা আমাকে তাড়িত করে যথেষ্টভাবে সময়ে কিংবা অসময়ে। অথচ মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তির দিক হতে অপরিহার্য বলে মনে করা হয় এই যৌনতাকেযদিও বলা হয়ে থাকে যে,অবস্থান ও মর্যাদাভেদে এটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। তাই বলা হয় যে, ছোট লোকের কামে ও ভদ্র লোকের কামে তফাত আছে। সাধারন লোকের কাম স্বাভাবিক কিন্তু একেবারেই ছ্যাঁচড়া(চৌধুরী: ১৪২৩(ব):২৭) যাকে আমরা বলতেই পারি অশ্লীলতা(কবীর: ২০১৪)। যেই শ্রেণীভেদেই ঘটুক না কেন-ভদ্রলোক বা ছোট লোক-এই কাম বা যৌনতা বা অশ্লীলতা-কোনটিকেই কি কারো অস্বীকার করার মতো সাহস আমার,আপনার আছে? নাকি জীবনের এ সকল অপরিহার্য কার্যকে এড়িয়ে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো মূর্খ হিসেবে? সম্ভবতঃ কেউ করতে তা সম্মত হবে না। আর এমনটা করলে জীবনকেই তুচ্ছ করতে হবে। এই জীবনকে তুচ্ছ করার মতো-সৎ সাহস আমাদের নেই? অন্ততঃ এতটুকু বলতে পারা যায় যে, একেবারেই নেই বলে শতভাগ নিশ্চিত। 

নিজের ভালোলাগার বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত হলেও অন্যের বিষয়ে সিকি ভাগও নই। তবে সন্দেহও নেই। যে নারীকে দেবতারাও পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। সেক্ষেত্রে আপনার বোঝার দায় না নিলেও আমার বোঝার চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। বাৎসায়ন নারী ও পুরুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে। কিন্তু নীরদ চন্দ্র চৌধুরী স্ত্রীদের তিন প্রকারে বিভক্ত করে ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি তাঁর বন্ধুর পথপরিক্রমায় তা উপলব্ধি করেন যা ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায় বলে উল্লখে করেন।  এই তিন প্রকার স্ত্রী হলেন ---

-       স্বীয়া

-       পরকীয়া

-       সামান্যবনিতা

এই তিন শ্রেণীর আলোচনার ব্যাখ্যা যাই থাকুক-আমাদের সমাজে প্রেম ভালোবাসার সাথে যৌনতার একটি সম্পর্ক আছে এবং পরকীয়া একটি উৎকৃষ্ট প্রেমের উদাহরণ হিসেবে অনেক বোদ্ধামহল মনে করেন। যদিও এ সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাতে সকল-সময়ে ও বিষয়ে সতর্ক আচরণ করতে হয় বলে নীরদ চন্দ্র হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এভাবে “যে কোনও দেশের ভদ্র সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ব্যাভিচার না স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কিত অন্যনীতি বিরুদ্ধ আচরণ কতটা পরিব্যপ্ত, তাহা নিরূপন করা সবসময়ই দুরূহ।” কারণ আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বরাবরই “বাহিরে ফিটফাট,ভিতরে সদরঘাট” নীতি অতি সর্ন্তপনে অনুসরন করে থাকি। আর এর ফলে অনাচার গোপন করা বা রাখাকে আমরা কর্তব্য বলে মনে করি। তাই উনিশ দশকের বিশশতকে শিখা পত্রিকায় পত্রিকায় (১৯২৬)-মূলমন্ত্র ছিল “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আদৃষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”। ইদানিংকালেও কি আমরা যৌনতা চর্চার ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন আমাদের সামাজিক জীবনের অভ্যাস কিংবা অনভ্যাসে দেখতে পাই। 

 

তাই, ভদ্র সমাজের না জানার ভাব ধরে রাখার মুশকিল হলো- এ বিষয়ে সঠিক সংখ্যার কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে, কানাঘুষা, নিন্দা, তামাশা, কেচ্ছা-কাহিনী আর ষোল প্রকারী পরিবেশনের মাধ্যমে আমরা যতটুকু জানতে পারি তাহার বিদ্যায়তনিকের ভাষায় নির্ভরতার তথ্য হতে পারেনা কিন্তু মনস্তাত্তিকের ভাষায় আশ্বস্ত তো হতে পারি। তাই,এরকম বিষয় সংশ্লিষ্ট তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্ক পরিবেশনের পাশাপাশি আমাদের মনে এও রাখতে হবে যে, ব্যক্তি বিশেষের অভিজ্ঞতায় সকল সময়ই একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই অর্জিত হয়ে থাকে, যা দর্শনের আরোহ কিংবা অবরোহ সূত্রানুসারে বৃহৎপরিসর বা জনগোষ্ঠীর কাজে লাগানো হয় বা বিচার করা হয় মাত্র। তাই যখন শুনি-

“ভ্রমর কইও গিয়া-

শ্রী-কৃষ্ণের বিচ্ছেদে অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে।

ভ্রমর কইও গিয়া।

কইও, কইও, কইও, রে ভ্রমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া

মুই রাধা মইরা যামু- কৃষ্ণ ছাড়া হইয়ারে

ভ্রমর কইও গিয়া

ভ্রমর রে -

আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর যাইব

রে ছাড়িয়া

আমার দেহের দুই ভাগ কইরা রাখিতাম 

বান্ধিয়া রে

ভ্রমর কইও গিয়া।

ভ্রমর রে

ভাইবে রাধা রমন বলে, শোনরে কালিয়া, নিভা ছিল মনের আগুন, কী দিলা জ্বালাইয়া রে- ভ্রমর কইও গিয়া।”

কূল রাই - এর এমন অনুভূতির পূর্বে শ্যাম যা বলেছিল - 

“আমার আসিবার কথা কইয়া 

মান করে রাই 

রইয়াছ ঘুমাইয়া।

আমার কথা নাই তোর মনে

প্রেম করছ আয়ানের সনে 

শুইয়া আছ নিজ পতি লইয়া।

আমি আর কতকাল থাকব রাধেগো

দুয়ারে দাঁড়াইয়া।”

রাধারমনের এ গানে আমরা রাধার প্রতি কৃষ্ণের অভিমান বুঝতে পারি। আরো জানতে পারি- রাধা তার নিজ স্বামী আয়ানের সাথে ঘুমাইয়া থাকলেও ইতঃপূর্বে অভিসারের কথা বেমালুম ভুলে গেছে বলে শ্যাম মনে করেন। শ্যাম এও মনে করেন-ঘন আধারে যমুনার ঘাটে তোমার আমার মিলনে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারতো; কারণ শাস্ত্রে বলে – “দূরাকীর্ণ ভূমি শয্যায় পরপুরুষ সঙ্গম নারীদের একান্ত প্রীতিকর (পূরবী:২০১৩:৮২)। সুতরাং বলা যায় যে, পরকীয়া একটি কেবল শিল্পও নয় বরং আত্মমোহনের মধ্য দিয়ে বিনোদনও বটে। যেটি নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। রাখাল বালকের এমন আবেদন গোয়াল কন্যা যে গ্রাহ্য করেনি তা নয়। বরং সেও অস্থির দূরাকীর্ণ ভূমি শয্যায় প্রীতিকর মিলনে। এমন একটি গান আমরা শুনতে পাই জসিম উদ্দীনের লেখায়--

“আমায় এতো রাত কেন ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে;

আমার নিভা ছিল মনের আগুন

জ্বালাইয়া গেলি রে।

---------------

শিয়রে শ্বাশুড়ী ঘুমাই, জ্বলন্ত নাগিনী

হায়রে হায় - জ্বলন্ত নাগিনী

আমার পইতানে ননদী শুয়ে- দুরন্ত নাগিনী

আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি।” (চৌধুরী:২০০০)

আদিমকাল কিংবা যুথবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তন প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায়, যৌথ পরিবার একটি অনুষঙ্গ উপাদান যা নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি বা এ বিজ্ঞানের বিদ্যাতয়নিক জানাশোনা অন্ততঃ তাই বলে। যেখানে স্বামীর সাথে স্ত্রী কিংবা স্বামীর অনুপস্থিতিতে শাশুড়ী, ননদ কিংবা অন্যরা ঘুমাবে এমন বাস্তব হালনাগাদ গ্রাম বাংলায় এখনও দেখা যায়। এমনও দেখা যায় যে,স্ত্রী অবশ্যাম্ভী প্রয়োজনে ঘরের বাহির হলে স্বামী কিংবা শ্বাশুড়ী অথবা ননদ অর্থ্যাৎ কেউ না কেউ সাথে থাকবে। সেখানে মাঝ রাতে রাধার একা ঘরের বাহির হওয়া, হাল নাগাদের কথা বিবেচনা করলেও দুঃসাধ্যও বটে।

অর্থ্যাৎ-শ্যামের আহবানে রাধার সাড়া দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় ছিলোনা। কারণ হিসেবে- জামাই, শাশুড়ী আর ননদীকে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রাতের আঁধারে ঘরের বাহির হয়ে দেখা করার অদম্য ইচ্ছাকে অবদমিত করতেই হয়। এ প্রেমের আবেগময় তাড়না, অভিমান একসময় পরিপূর্ণতা পায়, শ্যাম যখন গোকুল ছেড়ে চলে যান মথুরায়। আপাততঃ রাধা মান করলেও সেই অভিমান রাধা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। কারণ রাধা-কৃষ্ণের প্রাকৃতিক সম্পর্কের বন্ধনের দরুন শ্যামকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হলে, রাধা আর মান ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। বরং কূলবধুটি বিচ্ছেদে পীড়িত হয়ে তার সখিদের প্রতি অনুযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ করেন এভাবে ----

“সখি আমিই না হয় মান করেছিনু

তোরা তো সকলে ছিলি।

কেন নাহি ফিরাইলি।

-------------------

তোরা তো হরির স্বভাব জানিস

তার স্বভাবের চেয়ে পরভাব বেশি

তোরা তো হরির স্বভাব জানিস।

তার স্বভাব জেনেও রহিলি স্ব-ভাবে

ডাকিলি না পরবোধে।

তোদের পরমপুরুষ পরবোধে, ডাকিলি না পরবোধে।

তোরা তো চিনিস, হরিরে, প্রবোধ 

কেন দিলি নে সই;

ডাকিলি না পরবোধে, ডাকিলি না পরবোধে।” (কাজী নজরুল ইসলামের কীর্তন)

হরির প্রেমে উন্মত্ত রাধা, আর রাখ ঢাক রাখেনি বরং নারীর সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে রাগ-অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। সমাজ-সংস্কৃতিতে ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে আমরা নারীজাতির যে চিত্র বা প্রতীক পাই, সেই হিসেবে নিঃসন্দেহে রাধা বিদ্রোহের বিমূর্ত প্রতীকও বটে। আজকের যুগের আলোকিত ও শিক্ষিত নারীর চেয়ে-নিজের যৌন স্বাধীনতা প্রকাশে অনেক অনেক দূর এগিয়ে বটে। আজকের নারীবাদীরা নারীমুক্তির যে সকল পন্থা বাতলে দিয়েছে, সে সকল বাতলে দেওয়া পন্থার মধ্যে যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা হলো যৌন দাসত্ব থেকে নারীর মুক্ত হওয়া। ঘরে স্বামী সংসার রেখে- জনে জনে প্রেমিকের ভালোবাসা খুঁজে ফেরা কিংবা তাতে পুনরায় আত্মীকৃত হওয়ার বিপুল বাসনা যা নারীমুক্তির আন্দোলনে প্রথম ঝাণ্ডাধারী নারী যে বিনোদিনী তা এ তথ্য ও তত্ত্বের আলোকে বলা যায়? সবকিছুরই যখন অর‍ন্য রোদন হলো, তখন রাধা, কৃষ্ণকে অভিশাপ দেয় নারীর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে, যেখানে রয়েছে আত্মতৃপ্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা প্রতিশোধ স্পৃহা। শোনা যাক রাধার অভিশাপ বচনটি---- 

“তুমি আমারি মতোন জ্বলিও, জ্বলিও 

বিরহ কুসুম হার গলেতে পরিও 

তুমি যাইও যমুনার ঘাটে 

না মানি ননদীর বাধা

বনমালি তুমি পরজনমে হইও রাধা।

তুমি আমারি মতোন কান্দিও, কান্দিও

বদনে কৃষ্ণ নাম জপিও

তুমি বুঝিবে তখন, ......

নারীর বেদন

রাধারও প্রাণে কতো ব্যথা।

তুমি আমারি মতোন মরিও মরিও

শ্যামও কলঙ্কের হার গলাতে পড়িও।

তুমি পুড়িও তখন

আমারি মতোন

বুকে লইয়া, দুঃখের চিতা।

আমি মরিয়া হইবো

শ্রী নন্দের নন্দন

তোমারে বানাবো রাধা

লোকায়ত কিংবা ফোকগানের ঢং এ অঙ্গের জ্বলুনিতে আপাততঃ  জল কিংবা অভিশাপ বচনে সমাপ্তি হয়তো টানা যায় কিন্তু প্রশ্নটি যখন শুচিতার তখন এর উত্তর খোঁজার দায়ও পড়ে ।