এই ব্লগটি সন্ধান করুন

অনুবাদ- সাহিত্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনুবাদ- সাহিত্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২

ডেব্রিসের নিঃশব্দের কান্না

                                                 মূলঃ The Roadside, By Sadat Hasan Manto. 

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]

এটি বছরের সেই সময়। যেদিন আকাশ ছিল  নীল– পরিষ্কার এবং ঝকঝকেঠিক আজকের মত। একই মৃদু সূর্যালোক। পৃথিবী মিষ্টি স্বপ্নের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল;  ঠিক যেমনটি সে খুঁজে পায় আজো। এরকম একটি দিনে তার পাশে শুয়েআলাদীন রিসোর্টের  ৫০১ নম্বর কক্ষে আমি তাকে আমার স্ফীত হৃদয় দিয়েছিলাম,এটার সাথে -ওটার মিলন ঘটিয়েছিলাম, এমনকি আমার তপ্ত পেলভিস হাড়, তাকে দিয়ে ঠাণ্ডা করিয়েছিলাম; আমার ৩৪ -৩২  -৩৪ মাপের শরীরে কোথাও তার হাত রাখতে বাঁধাও দেইনি। 

 

সে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার জীবন শূন্য, অতৃপ্ততুমি আমাকে উপহার দেয়া  এই মুহূর্তগুলো দিয়ে পূর্ণ করেছো। আমি চিরকাল তোমার  কাছে কৃতজ্ঞ থাকবকারণ তুমি  ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ থাকতাম ... আমি জানি না তোমাকে আর কী বলব ... আমি সন্তুষ্ট বোধ করছি ... সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট। আমার মনে হয় তোমাকে আমার  লাগবে প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে।’  ৫০১ নম্বর কক্ষে আমি  চোখের জল ফেলেছিলাম, সে আমার  বিসর্জিত অশ্রু  মুছে দিয়েছিল ৩৪ মাপের অন্তর্বাসটি দিয়ে, যেটি  সে কিনে এনেছিল কলকাতা থেকে। আর আজ সে চলে গেছে ,আমার কাছ থেকে দূরে, হয়তো কখনো ফিরে আসার জন্য নয়?

আমার চোখে অশ্রু। আমার হৃদয় কেঁদেছিল।আমার পেলভিস হাড় ব্যাথায় কেঁপে উঠেছিল। আমি মিনতি করার চেষ্টা করেছি। আমি তাকে লক্ষ,লক্ষ বার জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছি, কেন তার আমার আর প্রয়োজন ছিল, আমরা যখন  দুইজনেই বিবাহিত; কেন সঙ্গোপনে আলাপন? তার জন্য আমার প্রয়োজনীয়তা কিসেতার সমস্ত, আর প্রচণ্ড রকমের ভয়ংকর তাগিদআমি এড়াতে পারিনি। বিশেষ করে সবিশেষ মুহুর্তগুলির পরে, যা তার সত্তার শূন্য স্থানগুলিকে পূর্ণ করেছিল। আমারও তাই । 

সে বলেছিল, 'এই মুহুর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে তুমি আমাকে পূর্ণ এবং শক্তিশালী করেছোতোমার প্রতিটি কণাপ্রতিটি পরমাণু দিয়ে আমার অতৃপ্ত সত্তাকে শক্তিশালী করেছো। কিন্তু এখন যেটা হয়ে গেছেতোমার সাথে আমার সম্পর্কটা আপনা-আপনিই ফিট হয়ে গেছে। 

কত নিষ্ঠুর তার কথাগুলো! পাথরের মতো আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এই কথাগুলোর কষ্ট আমি নিতে পারিনি। আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমার কান্নার কোন প্রভাব তার উপর পড়েনি। আমি বলেছিলাম, 'এই কণা এবং পরমাণুগুলির কথা তুমি বলছিলা - তারা একসময়  আমার অংশ ছিল। আমি যদি আমার নিজের কিছু অংশ তোমাকে দিয়ে থাকিআমি কি আজ সেই স্মৃতিগুলো মিস করছি নাতোমাকে পূর্ণ করতে গিয়ে আমি কি নিজেকে শূন্য করিনিআমি কি তোমাকে আমার সব উজাড় করে দেইনিআমার ঈশ্বরআমাকে মূর্তি বানিয়ে আমার উন্মুক্ত বক্ষে তোমাকে জড়িয়ে রাখিনি?'

 

সে বলেছিল, ‘মৌমাছি মধু উৎপাদনের জন্য কুঁড়ি ও ফুল চুষে খায়কিন্তু যে ফুলের জল -রস শুকিয়ে গেছে, সেই  ভ্রমরের ঠোঁটে মধু কখনও স্পর্শ করতে পারেনা। ঈশ্বর অন্যকে তাঁর উপাসনা করতে দেন; কিন্তু তিনি কখনই অন্যকে গ্রহণ করেন না

তাঁর প্রভু হিসাবে। সে -----  সাথে একাকী কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে লাপাত্তাকিন্তু সেই ঈশ্বর আজ কোথায়? সেই প্রভুর মতো তুমিও উত্তপ্ত বিছানায় আমার অনুরণন তৈরি করে আজ কেন দূরে থাকো?  

 

একজন নারী  কাঁদতে পারে কিন্তু তর্ক করতে পারে না। নারীর  সবচেয়ে বড় যুক্তি তার চোখ থেকে যে অশ্রু প্রবাহিত হয়। আমি তাকে বলেছিলাম, 'আমার দিকে তাকাওআমি কাঁদছি। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। যাওযদি করতেই হয়তবে আমার কিছু চোখের জল নিয়ে যাওতোমার স্মৃতির চাদরে মোড়ানো থাক। আমি এখন সারা জীবন কাঁদবতবে আমি এটা জেনে সান্ত্বনা পাব যে তুমি আমার অন্তত কিছু চোখের জল মুছে দিয়েছ  আর কিছু না হলেওঅন্তত আমাকে খুশি করার জন্য।

 

সে আমাকে কথায় কথায় বলেছিল, ‘আমি তোমাকে যথেষ্ট সুখ দিয়েছি। সমস্ত শরীর -----আমার কাছ থেকে তুমি যে আনন্দ পেয়েছো;তার স্মরণ কেন, সারাজীবন তোমাকে সমর্থন করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে নাতুমি আমাকে শক্তিশালী করতে  গিয়ে তোমাকে নিজেকে  অসম্পূর্ণ করে দিয়েছ। কিন্তু এই অসম্পূর্ণতা যে আমার  জীবনের বাকিটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্টআমি একজন মানুষ – তোমার ছোঁয়ায় আমি সম্পূর্ণ হয়ে উঠিআগামীকাল স্বামী প্রবরটি করবে। কিন্তু আমি তোমাতেই সম্পূর্ণ হই।  আগামীকাল অন্য কেউ এটা করবে; গতকাল কেউ করেছে, তবুও আমি সম্পূর্ণ হইনি। আমি সেভাবেই তৈরি। আমি প্রায়ই নিজেকে সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ অনুভব করতে চাই। আমার সত্তার শূন্যস্থান, পূরণ করতে, পেলভিস হাড় ভাঙতে এবং আমাকে বারবার সুস্থ ও শক্তিশালী একটি বোধ অনুভব করতে ইচ্ছুক তোমার সান্নিধ্য আমাকে মোহিত করে, না আর কারো নয়, বহুজন আমার শরীর ছুঁয়েছে, কিন্তু ছোঁয়ায় আমার শরীর নেচে উঠেনি বা শরীর নাচাতে পারেনি। তুমি কেন বুঝেও বুঝো না।

 

আমি কাঁদতে থাকি এবং হতাশ বোধ করি। এভারডিনের রাস্তায় ঘুরি। শরীর চায় কিছু, বুঝি , আমার ফ্ল্যাটমেট বুঝেসেও কয়েকবার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছে;তার নিরন্তর প্রচেষ্টার মাঝেঅবশেষে এক শীতের রাতে কাতর আমি তোমার শোকে। না, আমি কোন বাঁধা দেইনি; কিন্তু সেই ফ্ল্যাটমেট আমার শরীরকে নাচাতে পারেনি।  

 

আমি ভেবেছিলাম, ‘এই কয়েকটা মুহূর্ত যেগুলো আমার হাতের মুঠোয় ছিল... নানাআমি তার  হাতের মুঠোয় ছিলাম... কেন?আমি তার কাছে নিজেকে এতটা বিসর্জন দিলামকেন,আমি আমার হৃদয়কে সেই খাঁচায় পুরে দিলাম; আমি কি তবে পিছনের মুখ খোলা রেখেছিলামহ্যাঁএর মধ্যে একটি আনন্দ ছিলএকটি নির্দিষ্ট আনন্দ ছিলনিজেকে ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে। কিন্তু এটা কি ধরনের সংগ্রাম নাকি খচ্চরামিসে রয়ে -সয়ে নেতিয়ে গেল অল্পত্বেই, আমি চেয়েছিলাম তোমার মতো সবল আর মজবুতকিন্তু কোথায় তার আমার আর প্রয়োজন নেইসাথে থাকা ফ্ল্যাটমেটটি তার ক্ষণিক চাহিদা আগেই মিটিয়ে নিলো কয়েক মুহূর্তেই, তোমাকে,আমার দরকার ঢের বেশি, যা আমি তোমার কাছ থেকে পাই, অনেক বেশি। তুমি যতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছো এবং আমি ততই দুর্বল হয়েছি। যেন আকাশে দুটি মেঘের বজ্রমেলায় পরিণত বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ে খেলা; যা আমি তোমার সাথে খেলতে চাই, এবং অব্যাহত বজ্রপাত ঘটুক আমার গিরিখাতে; অতঃপর শুনশান নীরবতা। অথচ তোমার বেলায় --- । হে ঈশ্বর! এটা  কেমন  বিচারআকাশেরপৃথিবীরবা তাঁর যিনি তৈরি করেছেন এই রহস্যময় জগৎ?

 

 

দুই

আমি কাঁদতে থাকি এবং হতাশ বোধ করি, অসাড় শরীরে ঘুরি সাভারের রাস্তায় রাস্তায় -- 

'দুটি আত্মা একত্রিত হয়ে যায় এবং সেই মিলন থেকে মহাবিশ্বকে ঘিরে থাকে। এই সব কি নিছক কাব্যিক হাত তালি ছিলযদিও এটা সত্য যে দুটি আত্মা একত্রিত হয়ে, তোমার হাতুড়ির খোঁচা আমার পেলভিস হাড়ে আমি টের পাই এবং একটি একক বিন্দুতে মিলিত হয়;সৃষ্টি করে - একটি আত্মা এই ধরনের সৃষ্টি আমরা চাইনিআমিও না, তুমিও না? তবুও কেন তোমার দিক হতে আর এখন সাড়া পাই না। সেই অন্তর্বাসের কথা, আলাদীনের কথা, ৫০১ এর কথা, সবিই  কি তোমার ক্ষণিক তেষ্টা মিটানো ---।  

আজ বছরের এই সেই সময়; সেই দিন। আকাশ তার মতো করেই নীল বর্ণ ধারণ করেছে – পরিষ্কার এবং ঝকঝকে – সেই দিনের মতো। একই মৃদু সূর্যালোক। পৃথিবী যেন একটি মিষ্টি স্বপ্নের গন্ধ পেয়েছিলঠিক যেমনটি এখন, কিংবা আজ। আমি তোমার পাশে শুয়েআমার উষ্ণ হৃদয় তোমাকে দিয়েছিলাম--- তুমি খেলছিলে--- আমার ৩৪ সাইজ নিয়ে।তোমার দেয়া বিদেশী অন্তর্বাসটি তুমি নিজেই খুলেছিলে সেই ৫০১ এ । কিন্তু আজ তুমি আমার পাশে নেই। এটাই আজ পার্থক্য। আমার গিরিখাতটি  দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে? তুমিই কি আমার অপূর্ণতার কারণ












রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

নিঃশব্দের কান্না (THE CANDLE’S TEARS)

 

                                            মূলঃ  THE CANDLE’S TEARS, By Sadat Hasan Manto.

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]


মোমবাতিটি স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে ছিলদুধের হিমায়িত ফোঁটার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গলে পড়া মোমবাতির ফোঁটাগুলো। ছোট্ট মেয়ে লাজিনা হাতে একটা মুক্তার মালা নিয়ে কাঁদছিল। তার মা মোমের গলে পড়া বিন্দু/ফোঁটা  দিয়ে একটি  পুঁতির মালা তৈরি করে লাজিনার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। লাজিনা তার মোমের মালা গলায় পরে আনন্দে হাততালি দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাত নেমে গেল। গ্রামের একটি আধা ভাঙ্গা ঘরে মোমবাতিটি জ্বলে উঠল। এর একচোখা আলো ঘরের অন্ধকার  উবে গেল এবং কিছু মুহূর্তের জন্য ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু সময় পরে, ঘরটি আবারো ভয়ঙ্কর  অন্ধকার পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে গেলো, যেন একটি অবিচলিত অস্পষ্ট দৃষ্টি চারদিকে তাকাতে শুরু করে অনিশ্চয়তায় । 

ছোট্ট লাজিনা খাটের উপর দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েস্বপ্নে তার বন্ধু বিন্দুর সাথে লড়াই করে, এবং তাদের পুতুলের ছেলে -মেয়েদের বিয়ে দিবে না বলে তারা ঝগড়া করতে থাকে

লাজিনার মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ এবং ম্লান আলোকিত কাদামাখা মাটির রাস্তার দিকে আকুলভাবে তাকিয়ে ছিলেন। রাস্তার ওপারে লোহার খুঁটিতে ঝুলে থাকা একটি লণ্ঠন ডিসেম্বরের শীতের রাতে ঘুমন্ত প্রহরীর মতো নিভু নিভু। লাজিনার মা দেখছে, তার সামনে একটি বন্ধ রেস্তোরাঁ,ঘুমন্ত শহরে কুয়াশাছন্ন আকাশ,বারোটা বেজে গেলো ; সে কেঁপে উঠলতারপর নিজের উপর নীরবতার কম্বল টেনে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মাঝে মিষ্টি গানের সুর লাজিনার মায়ের কানে ভেসে উঠল কিন্তু ততক্ষণে তার মাথায় আরেকটি কথা ঢুকে গেছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস তার কানে পৌঁছল। লাজিনার মা গান শুনছেসে তার সমস্ত ইচ্ছা শক্তি দিয়ে তাতে মনোযোগ করছিল।

রাতের নিস্তব্ধতায়, নিঃশ্বাসের শব্দ যেন শেষ বিন্দুর মতো ঘণ্টায়বেজে উঠতে লাগল। লাজিনার মা তৃপ্তি নিয়ে বসলেন, যেন  একটি  ক্লান্ত ঘোড়া নিঃশব্দে  এসে লণ্ঠনের পাশে দাঁড়াল। এরপর সওয়ার নামলেন, ঘোড়াকে চাপ দিলেন এবং জানালার দিকে তাকালেন। জানালার ফাঁক গলিয়ে  ভিতরের ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।

এরপর সে শীতার্ত রাতের গুণ্ঠিত হাত খুলে পকেটে হাত দিয়ে  দেখতে পেল তার কাছে সাড়ে তিন টাকা আছেযার মধ্যে তিনি এক টাকা এবং চার আনা নিজের জন্য আলাদা করে রেখে এবং বাকিটা তিনি ঘোড়ার সিটের কুশনের নীচে লুকিয়ে রাখলেন। অতঃপর সে পতিতালয়ে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল — 

লাজিনার মাদরজা খুলতে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন -- 

সেই কোচম্যান — মাধোভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে চান্দো সুনিয়ারিকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে , কানে  বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন — 

"আল্লাহ জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি! যৌবনে তোমার সাথে দেখা হলে আমার ঘোড়া আর গাড়ি অনেক আগেই বিক্রি হয়ে যেত"  বলে তার হাতে এক টাকা গুঁজিয়ে দিলেন। 

চান্দো সুনিয়ারি জিজ্ঞেস করল, ‘এটুকুই কী?' 

'এটাও নাও,' এবং  এবার সে তার অন্য হাতে সাথে থাকা বাকি চার আনাও দিয়ে — ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অস্ফুট স্বরে  বলল  তোমার জীবনের শপথএইটুকুই আমার কাছে আছে।

ঘোড়াটা শীতের রাতে জমে আছে ভিতরে, আর মৃদুভাবে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘোড়াটি। এবং তার খুঁটির উপরে  রাখা লণ্ঠনটি আগের মতোই নিভে গেল। অন্ধকার — হিস হিস শব্দ --- 

মাধো লোহার খাটের উপর শুয়ে আছে, ক্লান্ত! পৃথিবীর কাছে মৃত যেন। তার পাশেই চন্দো সুনিয়ারি চোখ মেলে শুয়ে রইল,গলিত মোমের ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল, যেগুলো স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে ছোট ছোট দুধের বল হয়ে জমে গেছে। হঠাৎ মাধো, সে তার বিছানা থেকে উঠে এসে লাজিনার বিছানার পাশে গিয়ে বসল। মোমের ফোঁটায় লাজিনার বুক কেঁপে উঠল। চন্দো সুনিয়ারি ঝাপসা চোখ দেখছে কেউ যেন ছোট্ট লাজিনার সদ্য ফুটে উঠা শিমুল কাঁটার ন্যায় বক্ষ যুগল উপড়ে ফেলতে চাইছে  --  ঠিক যেন নিজের শৈশবে জমাট বাঁধা অশ্রুর ফোঁটার মধ্যে লুকিয়ে  থাকা কাহিনীর পুনরাবৃত্তি সে দেখছে। চন্দো সুনিয়ারি  কাঁপা কাঁপা হাত তুলে ছিঁড়ে ফেলল

লাজিনার গলা থেকে মোমের পুঁতি — । 

সুতোটি ছিঁড়ে গলিত মোমের পুঁতিগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়; পাথরের আলিঙ্গনে ঘুমিয়ে যায় চন্দো সুনিয়ারি। এখনঘরটি কেবল শান্ত নয়অন্ধকারও হয়ে উঠেছে-- আলোর চাইতে আঁধার  এখানে ঢের ভালো লাগে । 

 

সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০২২

কাপুরুষ (COWARD)

                                       

                                                                      মূলঃ  Sadat Hasan Manto 

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]

দিকে সাভার, ওদিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লী; মাঝখানে প্রমত্ত পদ্মা নদী। শীতের সকালে বেড়িয়ে পৌঁছালো সেই গোধূলি বেলায়,ভাবছিল রাতের কাম দিনেই শেষ করে সাভারে ফিরবে সন্ধ্যা বেলায়।তা আর হয়ে উঠল না তার। পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অভ্যাস মতো যানজট আজকে তাকে এখানে নিয়ে আসল প্রায় ৫ ঘণ্টা পর। গাড়ী থেকে নেমে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনে আগুন দিলো তাতে; একটু এগিয়ে যেতেই সে বাঁশের পুলটা দেখতে পেল। না এবারই প্রথম নয়। এখানকার ঘরগুলো, রাস্তা, এমনকি ল্যাম্প পোস্টের বাল্বগুলোও তাকে চিনতে পারে, যদি না পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের বদলিয়ে থাকে; ভাবছে ধীরে ধীরে এগুবে সে। খালের ধারে মাঠটি পরিষ্কার আর ফাঁকা আছে, শীতের গোধূলি তাই হাল্কা কুয়াশা পরছে বলে মনে হয়। ডঃ জারিফুর রহমান পি এইচডি, একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে হন হন করে হেঁটে বাঁশের সাঁকোটি পার হতে না হতেই, হাতের সিগারেটটিকে পায়ের তলায় পিষিয়ে মারল, যেভাবে সে নিজের বিবেক, নীতি,মূল্যবোধ,আর চরিত্রকে পিসে ফেলেছে ৫০ বছর আগে। এ জন্যই কেউ কেউ তাকে জাউরা জারিফ বলে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যে; ডঃজারিফ নিশ্চিত যে মিউনিসিপ্যালিটির ল্যাম্প পোস্টে লাগানো বৈদ্যুতিক বাতিটি তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে। সে দেখতে পেলো একটা খোলা উঠান— ভাগাড়ও বটে, কত শিশু! হয়তো এরাও আজ আমার মতো খয়রাতি টাকায় পি এইচ ডি করে নামের আগে ডঃ আর পিছে পি এইচ ডি লিখতে পারতো! যাকগে। সে এগুতে লাগলো ; পাতলা, মোটা , হাল্কা অথবা ভারী নিতম্বের নারীরা এখানে, ওখানে শুয়ে আছে কেউ বেঞ্চে, কেউ খাটে। নানা জন, নানা বর্ণ, হরেক রকম সাজ,ক্রিস-ক্রস ফ্যাশনে পাকা, সামনে এবং শুয়ে আছে – যেন সাদা কালো ভুবন থেকে দূরে আরেক রঙ্গিন জগতে আসলো। সে উঠোন পেরিয়ে কোণার বাড়িতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু সেই বাল্বটি যেটি তার অস্পষ্ট সূঁচ-তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার সংকল্পকে নড়বড় করে দিল এবং সে কয়েক পা দূরে বড় বাড়ীটি হতে; এ বাড়ীর পাশেই একটি ছোট নর্দমা। এ নর্দমা দিয়েই পৌর কর্তৃপক্ষ যৌন পল্লীর নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধরে রাখছে। নর্দমা পেরিয়ে উঠান পার হতে মাত্র কয়েক কদমের ব্যাপার। তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়ীটি।
জারিফুর রহমান সেই সাভার হতে যানজটের তীব্র যন্ত্রণা পেরিয়ে কিন্তু এখানে পৌঁছে গিয়েছিল। তার চিন্তা,তার পদক্ষেপের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছিল। চলতি পথের মাঝে অনেক কিছুতেই তার মন বসছে না। না সে কোন অস্থির প্রকৃতির মানুষ নয়। সে খুব ভাল করেই জানত যে সে একজন পতিতার কাছে যাচ্ছে এবং কেন সে তার কাছে যাচ্ছে তা সে আরও ভালভাবে জানতো।
তার দরকার একজন নারী—একজন নারী, তা সে যে ধরনের নারীই হোক না কেন— বুড়ি, ছুড়ি, কচি, ডিভোর্সি , মোটা,কালো, ফর্সা। একজন নারীর প্রয়োজন হঠাৎ করে দেখা দেয়নি; এটিই তার বর্তমান রূপ; না পাওয়া পর্যন্ত সদা তৎপর থেকেছে – বাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কর্মক্ষেত্রেও সে সুযোগ্কে হাত ছাড়া করেনি। হঠাৎ, কেন জানি তার মনে হল যে সে আজ একজন মহিলা ছাড়া আর একটি মুহূর্তও বাঁচতে পারবেন না। এমনটা মনে হলেই সে প্রমত্ত পদ্মা পাড়ি দিয়ে এখানে চলে আসে। তাকে অবশ্যই একজন মহিলা পেতে হবে – এমন একজন মহিলা, যার ঊরুতে সে হালকা থাপ্পড় মারতে পারবে, যার কণ্ঠস্বরে সে শুনতে পাবে যৌনতা, এমন একজন মহিলা, যার সাথে সে সবচেয়ে অশ্লীলভাবে কথা বলতে পারবে।
জারিফ একজন শিক্ষিত, বিচক্ষণ ধরনের মানুষ; চাকরি করেন। সে অধিকার-অন্যায় জানে।কিন্তু এ বিষয়ে আর ভাবতে পারছিলনা। তার গভীরে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল; এটা কোনোভাবেই নতুন ইচ্ছা ছিল না। এটি এর আগে বেশ কয়েকবার মাথা চাড়া দিয়েছিল এবং প্রতিবার তার পক্ষ থেকে অসংখ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও হতাশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। পরাজিত হয়ে, সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে সে একজন নারী না পাওয়া পর্যন্ত সন্ধান চালিয়ে যাবে।সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল এবং কোন একদিন দেখা যাবে যে সে একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা কোনও মহিলার উপর আক্রমণ করে বসতে পারে; ঠিক যেমন একটি পাগলা কুকুর যে কোনও পথচারীকে কামড়াতে পারে।
এতক্ষণে সেই প্রতিচ্ছবি তার মন থেকে চলে গেছে – একজন মহিলার প্রতিমূর্তি যার ঠোঁটে, সে ভেবেছিল, সে ফুলের উপর প্রজাপতির মতো করে নিজেকে বিশ্রাম দেবে। এবার সে তার গরম ঠোঁট দিয়ে সেই ঠোঁটগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে চাইল। মহিলার কানে মিষ্টি কিছু বকবক করার চিন্তাও তাকে এতক্ষণে ধরে বসেছে। সে জোরে কথা বলতে চেয়েছিল- যা নগ্ন ছিল।
এখন তার মনে একক, সম্পূর্ণ একটি সেক্সি নারী। সে এমন একজন মহিলাকে চায় যাকে দেখতে সেক্সি মনে হয়। সে আসলে এমন একজনকে খুঁজছিল সে হবে অর্ধেক মহিলা এবং অর্ধেক পুরুষ ।
একটা সময় ছিল যখন জারিফ ‘নারী’ শব্দটি মুখে নিলেই তার চোখে এক বিশেষ ধরনের আর্দ্রতা অনুভব করত, বিশেষ অঙ্গে ভেজা অনুভব করতো; যখন নারীর কথা ভাবলেই সে আনমনা হয়ে যেত। সে উচ্চারণ করত – ‘নারী’ – অত্যন্ত যত্ন সহকারে, যেন এই নিষ্প্রাণ শব্দটি অসতর্ক উচ্চারণে ভেঙে যেতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে সে এই নির্ভেজাল আনন্দটি উপভোগ করে চলেছে আজ অবধি।
জারিফ এবার স্বপ্নের জগৎ ছেড়ে বাস্তবে। অনেক দিন ধরে সে তার এলোমেলো চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু এখন তার শরীর ভয়ানকভাবে জেগে উঠেছে। তার কল্পনার দ্রুততা তার শারীরিক সংবেদনগুলিকে অনুভূতির এমন সূক্ষ্ম অঞ্চলে পরিণত করেছিল যে, জীবন তার জন্য সূঁচের বিছানায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি চিন্তা এক একটি বর্শায় পরিণত হয়েছে এবং কল্পিত মহিলাটি এমন একটি আকৃতি ও রূপ ধারণ করেছিল সে চাইলেও, তার বর্ণনা করা কঠিন ছিল।
জারিফ একসময় মানুষ ছিল; কিন্তু এখন সে মানুষকে ঘৃণা করে, এতটাই যে সে নিজেকেও ঘৃণা করে এখন। আর সেজন্যই সে নিজেকে এমনভাবে হেয় করতে চায় । সে বলে উঠে — “আমি নিজেকে পরিমার্জনা করতে ব্যর্থ হয়েছি, কারণ আমার চারপাশেই নোংরা। আমি এখন এই ময়লা দিয়ে আমার দেহ ও আত্মার প্রতিটি পরমাণু এবং ছিদ্র ধ্বংস করতে চাই। আমার নাক, যেটা একসময় সুগন্ধের খোঁজে বেড়াতো এখন সেটা দুঃগন্ধ শুঁকবার আশায় কাঁপছে। আর তাই আজ পুরানো চিন্তার চাদর ত্যাগ করে এই পাড়ায় চলে এসেছি, যেখানে সব কিছু একটা রহস্যময় দুর্গন্ধে ঢেকে আছে। এই পৃথিবী ভয়ংকর সুন্দর! আমি এখানেই স্নান করবো ।”
বাতির আলোয় জারিফ ধান্দার চোখে উঠানের দিকে তাকাল। দেখে মনে হয়েছিল যেন বেশ কিছু নগ্ন মহিলা সেখানে শুয়ে আছে-কারো খোলা পিঠ, অন্যরা মুখ নিচু করে; এলো মেলো শাড়ি আঁচল, অন্তর্বাস খুল্লাম খুলা ।সে সংকল্প করল কোনমতে মাঠ পেরিয়ে কোণার বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির বাল্বটি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে এগুবার সাহস না পেয়ে পিছিয়ে গেল এবং থমকে দাঁড়ালো। ব্যর্থ হয়ে ভাবতে লাগলো —“ বাতিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? কেনইবা আজ পথে পথে পাথর ছড়ানো।“
সে জানত যে এটি তার কল্পনার ছবি এবং বাস্তবতার সাথে এর কিছুই মিল নেই। তবুও, সে পিছু হটল এবং সে তার মাথার সমস্ত কুৎসিত চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলার জন্য নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল যে যে বিগত পঞ্চাশ বছরের এই দ্বিধা যা তাকে উত্তরাধিকার হিসাবে দান করা হয়েছিল সেটা আজ বাতির মধ্যে ঢুকে গেছে। সেই সঙ্কুচিত দ্বিধা, যা সে ভেবেছিল সেই ফেলে আসা দ্বিতীয় চামড়ার মতো বাড়িতে রেখে আসা মুখোশ, তার আসার অনেক আগেই এখানে পৌঁছে গেছে –এখানে সে তার জীবনের সবচেয়ে নোংরা খেলা খেলতে চলেছে। এমন একটি খেলা যা তাকে পতিতাদের বিসটা দিয়ে ঢেকে দেবে এবং তার এ দিয়েই তার আত্মাকে করে ফেলবে পুত -পবিত্র ?
এই বাড়িতে এক মধ্য বয়স্ক মহিলা বাস করে ।সে সকল সময় কালো চশমা পরে থাকে; তার সাথে চার-পাঁচজন যুবতী থাকে , এরা রূপের পসরা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে – তা দিনের আলোতে হোক বা রাতের অন্ধকারে। এই মহিলারা সারা দিন রাত মেশিনের মতো কাজ করে। এক বন্ধু জাউরা জারিফকে তাদের কথা বলেছিল, সেখানে অসংখ্যবার প্রেম ও সৌন্দর্যের লাশ দাফন করতে দেখেছে সে। বন্ধুটি জারিফকে বলত, “যখনই আমি একজন মহিলার প্রয়োজন অনুভব করি তখনই আমি দৌলতদিয়ার পতিতালয়ের সবচেয়ে পছন্দের সঙ্গী খুঁজে পাই। ঈশ্বরের কসম, এখানকার নারী যেন নারী নয়; এক একটা ডানা কাঁটা —-! আল্লাহ যেন তাকে কেয়ামত পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখেন!”
চার-পাঁচজন নারীর মধ্যে জারিফের মনে বিশেষ কোনো কিছু নাই। “আমি কোনটা পাব তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি নগদ টাকা তুলে দিবো আর বিনিময়ে দু দণ্ড শান্তি নিয়ে সাভারে ফিরে যাবো! … একজন মহিলাকে আমার হাতে তুলে দিলে , আমার এক সেকেন্ড বিলম্ব করা উচিত নয় । কোন অলস সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পরা উচিত। সামান্যতম ভদ্র কথোপকথনও নয়। ধরো তক্তা, মারো পেরেক অবস্থা।“
অস্থির হয়ে ওঠে ডঃ জারিফ। তার মধ্যে একটা কোলাহল ওঠে। সে এখন এতটাই দৃঢ়ভাবে মনস্থির করে ফেলেছে যে, যদি পাহাড় তার পথ বন্ধ করে দেয়, সেগুলিও সে ডিঙ্গিয়ে ওই বাড়িতে যাবে। কিন্তু মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের লাগানো বাতি, যা বাতাসের স্বল্প ঝাঁকুনিতে ছিঁড়ে যেতে পারে, সেই বাতির আলো তার সামনে একটি অপ্রতিরোধ্য বাধা হয়ে দাঁড়ালো। জারিফুর রহমান, নিজের লালিত অভ্যাস মতো পৌর কর্তৃপক্ষকে গালাগাল দিতে না দিতেই বাতিটি যেন প্রতিধ্বনি করতে লাগলো – “জারিফ তুই একটা খবিশ?”
সে দেখতে পেলো পাশেই একটা পানের দোকান খোলা। আলো ছিল। নগ্ন বাল্বের আলোর চারপাশে মাছিগুলো ভনভন করে যেন তাদের ডানাগুলো আগুণখেকো হয়ে গেছে। জারিফ মাছিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখার পর তার জ্বালা যেন বেড়ে গেল। ‘এটা করার’ সংকল্প, যা নিয়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। বারবার সেই মাছিগুলির সাথে পরস্পরের সংঘর্ষের ধাক্কা তাকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে তার মাথার ভিতর একটা ঝড় বয়ে যেতে থাকে। “আমি ভয় পাচ্ছি… আমি আতঙ্কিত… আমি আলোকে ; বাতিকে ভয় পাচ্ছি… এটা আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে ! আমি কাপুরুষ… আমি কাপুরুষ… আমার লজ্জিত হওয়া উচিত আমার নিজের জন্য।“
জীবনের কিছু চিহ্ন তখনও জারিফুর রহমানের সামনে, অর্থাৎ অন্য দিকে দৃশ্যমান ছিল পতিতালয়ের দোকানগুলোর উপরে সারিবদ্ধভাবে যৌনশিল্পীদের ঘর খানিকটা খালের ওপাশে। সরাসরি তার সামনে, একটি কালোমতন মহিলা একটি জানালার পাশে বসে একটি বৈদ্যুতিক আলোর তীক্ষ্ণ ঝলকানিতে নিজের উন্নত বক্ষ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। একটি নগ্ন বাল্ব সরাসরি বেশ্যার উপরে ঝুলছে এবং ঠিক যেন আগুনের একটি সাদা-গরম বলের মতো দেখাচ্ছিল যা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এবং জারিফুরের মাথার উপর দিয়ে গলে গলে পরছে ।
জারিফ সেই কালো মহিলার কথা গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করছিল যখন সে বাজারের দূরপ্রান্ত থেকে কিছু মোটা কণ্ঠস্বর সবচেয়ে অশ্লীল শ্লোগান শুনেছিল সে দাঁড়িয়ে ছিল বটে কিন্তু ওই প্রান্তটি তার কাছে দৃশ্যমান ছিল না। কিন্তু অশ্লীল কিছু শব্দ আর গালাগাল কানে এসেছিল।
জারিফ এখন নিজেকে আগের চেয়ে বেশি তুচ্ছ মনে করতে লাগলো। “তুমি… তুমি… তুমি… তুমি কী? আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি … সব পরে, তুমি কি? তুমি এও নও ,ওটাও নও… তুমি মানুষও নও, জানোয়ারও না… তোমার শিক্ষা, তোমার পি এইচ ডি, তোমার বুদ্ধি, তোমার ভালো থেকে মন্দ বলার ক্ষমতা- সবই নষ্ট হয়ে গেছে। দেখ , তিনজন মাতাল লোক আসে। তোমার মত নয়, তারা কোন স্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আসেনি। কিন্তু কোন ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই, তারা বেশ্যার সাথে কথা বলে, তারা হাসে, তারা খুনসুটি করে এবং তারা আমার খাদে উঠে যায় ,আমার নদীতে সাঁতার কাটে ইচ্ছেমত; যেমন সহজ … যেন তারা একটি ঘুড়ি উড়াতে যাচ্ছে। আর তুমি… তুমি… তুমি…. ভালো করেই জানো, তোমার কী করা উচিত, বাতির ভয়ে বাজারের মাঝখানে স্টুপিডের মতো দাঁড়িয়ে থাক! তোমার ইচ্ছা ,এতই পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ, তবুও তোমার পা তোমাকে এগিয়ে নিতে অস্বীকার করে… তোমার লজ্জা!’ এটা তোমার কাপুরুষতা।“
পতিতার এমন খেদোক্তিতে এক মিনিটের জন্য নিজের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা তার মধ্যে জেগে উঠল। তার পা কেঁপে উঠল এবং সে সরে গেল, এক লাফে নর্দমা পার হয়ে পতিতালয়ের দিকে যেতে লাগল। সে সিঁড়িতে উঠতে চলেছে এমন সময় একজন লোক নেমে আসছে। জারিফ দ্রুত পিছিয়ে গেল। সে নিজেকে আড়াল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা লোকটি তাকে কোনও কর্ণপাত করলো না ।
লোকটি তার মূল কুর্তা খুলে তার কাঁধে রেখেছিল। তার ডান হাতের কব্জিতে সুগন্ধি। ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে। জারিফের অস্তিত্ব অস্বীকার করে লোকটি উঠান পেরিয়ে নর্দমা লাফিয়ে চলে গেল। জারিফ ভাবতে লাগলো কেন লোকটা তার দিকে একবারও তাকালো না।
এদিকে, সে বাতির দিকে যেই তাকাল অমনি প্রতিধ্বনি শুনতে পেলো— “তুমি কখনই তোমার পরিকল্পনায় সফল হবে না কারণ তুমি কাপুরুষ। তোমার কি মনে আছে, গত বছর, যখন তুমি তোমার সহকর্মীটিকে বউ ঘোষণা করেছিলে, মেপেছিলে শরীরের ভাঁজ, কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই তোমার শরীরের প্রতি আউন্স শক্তি কেমন করে হারিয়ে গিয়েছিল? তুমি কতটা ভয় পেয়েছিলে? ক্যান্টনমেন্ট এ ডেটিং করতে গিয়ে এমপি পুলিশের কাছে থতমত খেয়ে ভয়ে কাপড় ভিজিয়েছিলে কিংবা তোমারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পরে তুমি সাহস দেখাতে পারনি? মনে আছে? সেই চিন্তা কীভাবে তোমাকে ভয় দেখিয়েছিল? তুমি ভয় পেয়েছিলে? আজ আমি দেখব, তুমি সিঁড়ি বেয়ে কিভাবে উপরে উঠো … আমি দেখব তুমি কিভাবে সাহস যোগাও।“
জারিফের সংকল্পে যা কিছু ছিল তা নিমিষেই উবে গেল। তার মনে হতে থাকে যে সে সত্যিকারের প্রথম শ্রেণীর একজন কাপুরুষ। অতীতের ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে একে একে ।তার মন, বইয়ের পাতার মতো একটা তীব্র দমকা হাওয়ায় এবং প্রথমবারের মতো সে সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলো যে তার অস্তিত্বের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অস্থিরতা লুকিয়ে রেখেছে এবং এটি তাকে করুণ কাপুরুষে পরিণত করেছে।
সিঁড়ি দিয়ে কারো নামার শব্দ জারিফুর শুনতে পেলো । সে কেঁপে উঠলো। একটি মেয়ে যে রাতেও কালো চশমা পরেছিল এবং যার সম্পর্কে সে তার বন্ধুর কাছ থেকে অনেক কিছু শুনেছিল। জারিফ ঘাবড়ে গেল। সে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো; মেয়েটির দরাজ কণ্ঠে জারিফ ভড়কে গেলো , “তুমি, ওখানে কেন সোনা , একটুও … ভয় পেওনা, আমার ভালোবাসা… এসো… এসো ।“ সে এবার জোরে ডাক দিল, “এসো… এসো।“
সে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো , আবার শুনতে পেলো , “এসো, আমার প্রিয় সোনা, এখন এসো।“
জারিফ দৌড় দিলো আতংকগ্রস্থ হয়ে। লাফিয়ে নর্দমা পার হতে গিয়ে, সে নর্দমার মাঝখানে উপুড় হয়ে পরে গেলো;পুরোমুখ পতিতাদের মলমূত্রে ভরে গেলো।