এই ব্লগটি সন্ধান করুন

সাদাত হাসান মান্টো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সাদাত হাসান মান্টো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২

ডেব্রিসের নিঃশব্দের কান্না

                                                 মূলঃ The Roadside, By Sadat Hasan Manto. 

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]

এটি বছরের সেই সময়। যেদিন আকাশ ছিল  নীল– পরিষ্কার এবং ঝকঝকেঠিক আজকের মত। একই মৃদু সূর্যালোক। পৃথিবী মিষ্টি স্বপ্নের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল;  ঠিক যেমনটি সে খুঁজে পায় আজো। এরকম একটি দিনে তার পাশে শুয়েআলাদীন রিসোর্টের  ৫০১ নম্বর কক্ষে আমি তাকে আমার স্ফীত হৃদয় দিয়েছিলাম,এটার সাথে -ওটার মিলন ঘটিয়েছিলাম, এমনকি আমার তপ্ত পেলভিস হাড়, তাকে দিয়ে ঠাণ্ডা করিয়েছিলাম; আমার ৩৪ -৩২  -৩৪ মাপের শরীরে কোথাও তার হাত রাখতে বাঁধাও দেইনি। 

 

সে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার জীবন শূন্য, অতৃপ্ততুমি আমাকে উপহার দেয়া  এই মুহূর্তগুলো দিয়ে পূর্ণ করেছো। আমি চিরকাল তোমার  কাছে কৃতজ্ঞ থাকবকারণ তুমি  ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ থাকতাম ... আমি জানি না তোমাকে আর কী বলব ... আমি সন্তুষ্ট বোধ করছি ... সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট। আমার মনে হয় তোমাকে আমার  লাগবে প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে।’  ৫০১ নম্বর কক্ষে আমি  চোখের জল ফেলেছিলাম, সে আমার  বিসর্জিত অশ্রু  মুছে দিয়েছিল ৩৪ মাপের অন্তর্বাসটি দিয়ে, যেটি  সে কিনে এনেছিল কলকাতা থেকে। আর আজ সে চলে গেছে ,আমার কাছ থেকে দূরে, হয়তো কখনো ফিরে আসার জন্য নয়?

আমার চোখে অশ্রু। আমার হৃদয় কেঁদেছিল।আমার পেলভিস হাড় ব্যাথায় কেঁপে উঠেছিল। আমি মিনতি করার চেষ্টা করেছি। আমি তাকে লক্ষ,লক্ষ বার জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করেছি, কেন তার আমার আর প্রয়োজন ছিল, আমরা যখন  দুইজনেই বিবাহিত; কেন সঙ্গোপনে আলাপন? তার জন্য আমার প্রয়োজনীয়তা কিসেতার সমস্ত, আর প্রচণ্ড রকমের ভয়ংকর তাগিদআমি এড়াতে পারিনি। বিশেষ করে সবিশেষ মুহুর্তগুলির পরে, যা তার সত্তার শূন্য স্থানগুলিকে পূর্ণ করেছিল। আমারও তাই । 

সে বলেছিল, 'এই মুহুর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে তুমি আমাকে পূর্ণ এবং শক্তিশালী করেছোতোমার প্রতিটি কণাপ্রতিটি পরমাণু দিয়ে আমার অতৃপ্ত সত্তাকে শক্তিশালী করেছো। কিন্তু এখন যেটা হয়ে গেছেতোমার সাথে আমার সম্পর্কটা আপনা-আপনিই ফিট হয়ে গেছে। 

কত নিষ্ঠুর তার কথাগুলো! পাথরের মতো আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এই কথাগুলোর কষ্ট আমি নিতে পারিনি। আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমার কান্নার কোন প্রভাব তার উপর পড়েনি। আমি বলেছিলাম, 'এই কণা এবং পরমাণুগুলির কথা তুমি বলছিলা - তারা একসময়  আমার অংশ ছিল। আমি যদি আমার নিজের কিছু অংশ তোমাকে দিয়ে থাকিআমি কি আজ সেই স্মৃতিগুলো মিস করছি নাতোমাকে পূর্ণ করতে গিয়ে আমি কি নিজেকে শূন্য করিনিআমি কি তোমাকে আমার সব উজাড় করে দেইনিআমার ঈশ্বরআমাকে মূর্তি বানিয়ে আমার উন্মুক্ত বক্ষে তোমাকে জড়িয়ে রাখিনি?'

 

সে বলেছিল, ‘মৌমাছি মধু উৎপাদনের জন্য কুঁড়ি ও ফুল চুষে খায়কিন্তু যে ফুলের জল -রস শুকিয়ে গেছে, সেই  ভ্রমরের ঠোঁটে মধু কখনও স্পর্শ করতে পারেনা। ঈশ্বর অন্যকে তাঁর উপাসনা করতে দেন; কিন্তু তিনি কখনই অন্যকে গ্রহণ করেন না

তাঁর প্রভু হিসাবে। সে -----  সাথে একাকী কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে লাপাত্তাকিন্তু সেই ঈশ্বর আজ কোথায়? সেই প্রভুর মতো তুমিও উত্তপ্ত বিছানায় আমার অনুরণন তৈরি করে আজ কেন দূরে থাকো?  

 

একজন নারী  কাঁদতে পারে কিন্তু তর্ক করতে পারে না। নারীর  সবচেয়ে বড় যুক্তি তার চোখ থেকে যে অশ্রু প্রবাহিত হয়। আমি তাকে বলেছিলাম, 'আমার দিকে তাকাওআমি কাঁদছি। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। যাওযদি করতেই হয়তবে আমার কিছু চোখের জল নিয়ে যাওতোমার স্মৃতির চাদরে মোড়ানো থাক। আমি এখন সারা জীবন কাঁদবতবে আমি এটা জেনে সান্ত্বনা পাব যে তুমি আমার অন্তত কিছু চোখের জল মুছে দিয়েছ  আর কিছু না হলেওঅন্তত আমাকে খুশি করার জন্য।

 

সে আমাকে কথায় কথায় বলেছিল, ‘আমি তোমাকে যথেষ্ট সুখ দিয়েছি। সমস্ত শরীর -----আমার কাছ থেকে তুমি যে আনন্দ পেয়েছো;তার স্মরণ কেন, সারাজীবন তোমাকে সমর্থন করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে নাতুমি আমাকে শক্তিশালী করতে  গিয়ে তোমাকে নিজেকে  অসম্পূর্ণ করে দিয়েছ। কিন্তু এই অসম্পূর্ণতা যে আমার  জীবনের বাকিটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্টআমি একজন মানুষ – তোমার ছোঁয়ায় আমি সম্পূর্ণ হয়ে উঠিআগামীকাল স্বামী প্রবরটি করবে। কিন্তু আমি তোমাতেই সম্পূর্ণ হই।  আগামীকাল অন্য কেউ এটা করবে; গতকাল কেউ করেছে, তবুও আমি সম্পূর্ণ হইনি। আমি সেভাবেই তৈরি। আমি প্রায়ই নিজেকে সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ অনুভব করতে চাই। আমার সত্তার শূন্যস্থান, পূরণ করতে, পেলভিস হাড় ভাঙতে এবং আমাকে বারবার সুস্থ ও শক্তিশালী একটি বোধ অনুভব করতে ইচ্ছুক তোমার সান্নিধ্য আমাকে মোহিত করে, না আর কারো নয়, বহুজন আমার শরীর ছুঁয়েছে, কিন্তু ছোঁয়ায় আমার শরীর নেচে উঠেনি বা শরীর নাচাতে পারেনি। তুমি কেন বুঝেও বুঝো না।

 

আমি কাঁদতে থাকি এবং হতাশ বোধ করি। এভারডিনের রাস্তায় ঘুরি। শরীর চায় কিছু, বুঝি , আমার ফ্ল্যাটমেট বুঝেসেও কয়েকবার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছে;তার নিরন্তর প্রচেষ্টার মাঝেঅবশেষে এক শীতের রাতে কাতর আমি তোমার শোকে। না, আমি কোন বাঁধা দেইনি; কিন্তু সেই ফ্ল্যাটমেট আমার শরীরকে নাচাতে পারেনি।  

 

আমি ভেবেছিলাম, ‘এই কয়েকটা মুহূর্ত যেগুলো আমার হাতের মুঠোয় ছিল... নানাআমি তার  হাতের মুঠোয় ছিলাম... কেন?আমি তার কাছে নিজেকে এতটা বিসর্জন দিলামকেন,আমি আমার হৃদয়কে সেই খাঁচায় পুরে দিলাম; আমি কি তবে পিছনের মুখ খোলা রেখেছিলামহ্যাঁএর মধ্যে একটি আনন্দ ছিলএকটি নির্দিষ্ট আনন্দ ছিলনিজেকে ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে। কিন্তু এটা কি ধরনের সংগ্রাম নাকি খচ্চরামিসে রয়ে -সয়ে নেতিয়ে গেল অল্পত্বেই, আমি চেয়েছিলাম তোমার মতো সবল আর মজবুতকিন্তু কোথায় তার আমার আর প্রয়োজন নেইসাথে থাকা ফ্ল্যাটমেটটি তার ক্ষণিক চাহিদা আগেই মিটিয়ে নিলো কয়েক মুহূর্তেই, তোমাকে,আমার দরকার ঢের বেশি, যা আমি তোমার কাছ থেকে পাই, অনেক বেশি। তুমি যতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছো এবং আমি ততই দুর্বল হয়েছি। যেন আকাশে দুটি মেঘের বজ্রমেলায় পরিণত বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ে খেলা; যা আমি তোমার সাথে খেলতে চাই, এবং অব্যাহত বজ্রপাত ঘটুক আমার গিরিখাতে; অতঃপর শুনশান নীরবতা। অথচ তোমার বেলায় --- । হে ঈশ্বর! এটা  কেমন  বিচারআকাশেরপৃথিবীরবা তাঁর যিনি তৈরি করেছেন এই রহস্যময় জগৎ?

 

 

দুই

আমি কাঁদতে থাকি এবং হতাশ বোধ করি, অসাড় শরীরে ঘুরি সাভারের রাস্তায় রাস্তায় -- 

'দুটি আত্মা একত্রিত হয়ে যায় এবং সেই মিলন থেকে মহাবিশ্বকে ঘিরে থাকে। এই সব কি নিছক কাব্যিক হাত তালি ছিলযদিও এটা সত্য যে দুটি আত্মা একত্রিত হয়ে, তোমার হাতুড়ির খোঁচা আমার পেলভিস হাড়ে আমি টের পাই এবং একটি একক বিন্দুতে মিলিত হয়;সৃষ্টি করে - একটি আত্মা এই ধরনের সৃষ্টি আমরা চাইনিআমিও না, তুমিও না? তবুও কেন তোমার দিক হতে আর এখন সাড়া পাই না। সেই অন্তর্বাসের কথা, আলাদীনের কথা, ৫০১ এর কথা, সবিই  কি তোমার ক্ষণিক তেষ্টা মিটানো ---।  

আজ বছরের এই সেই সময়; সেই দিন। আকাশ তার মতো করেই নীল বর্ণ ধারণ করেছে – পরিষ্কার এবং ঝকঝকে – সেই দিনের মতো। একই মৃদু সূর্যালোক। পৃথিবী যেন একটি মিষ্টি স্বপ্নের গন্ধ পেয়েছিলঠিক যেমনটি এখন, কিংবা আজ। আমি তোমার পাশে শুয়েআমার উষ্ণ হৃদয় তোমাকে দিয়েছিলাম--- তুমি খেলছিলে--- আমার ৩৪ সাইজ নিয়ে।তোমার দেয়া বিদেশী অন্তর্বাসটি তুমি নিজেই খুলেছিলে সেই ৫০১ এ । কিন্তু আজ তুমি আমার পাশে নেই। এটাই আজ পার্থক্য। আমার গিরিখাতটি  দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে? তুমিই কি আমার অপূর্ণতার কারণ












রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

নিঃশব্দের কান্না (THE CANDLE’S TEARS)

 

                                            মূলঃ  THE CANDLE’S TEARS, By Sadat Hasan Manto.

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]


মোমবাতিটি স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে ছিলদুধের হিমায়িত ফোঁটার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গলে পড়া মোমবাতির ফোঁটাগুলো। ছোট্ট মেয়ে লাজিনা হাতে একটা মুক্তার মালা নিয়ে কাঁদছিল। তার মা মোমের গলে পড়া বিন্দু/ফোঁটা  দিয়ে একটি  পুঁতির মালা তৈরি করে লাজিনার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। লাজিনা তার মোমের মালা গলায় পরে আনন্দে হাততালি দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাত নেমে গেল। গ্রামের একটি আধা ভাঙ্গা ঘরে মোমবাতিটি জ্বলে উঠল। এর একচোখা আলো ঘরের অন্ধকার  উবে গেল এবং কিছু মুহূর্তের জন্য ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু সময় পরে, ঘরটি আবারো ভয়ঙ্কর  অন্ধকার পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে গেলো, যেন একটি অবিচলিত অস্পষ্ট দৃষ্টি চারদিকে তাকাতে শুরু করে অনিশ্চয়তায় । 

ছোট্ট লাজিনা খাটের উপর দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েস্বপ্নে তার বন্ধু বিন্দুর সাথে লড়াই করে, এবং তাদের পুতুলের ছেলে -মেয়েদের বিয়ে দিবে না বলে তারা ঝগড়া করতে থাকে

লাজিনার মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ এবং ম্লান আলোকিত কাদামাখা মাটির রাস্তার দিকে আকুলভাবে তাকিয়ে ছিলেন। রাস্তার ওপারে লোহার খুঁটিতে ঝুলে থাকা একটি লণ্ঠন ডিসেম্বরের শীতের রাতে ঘুমন্ত প্রহরীর মতো নিভু নিভু। লাজিনার মা দেখছে, তার সামনে একটি বন্ধ রেস্তোরাঁ,ঘুমন্ত শহরে কুয়াশাছন্ন আকাশ,বারোটা বেজে গেলো ; সে কেঁপে উঠলতারপর নিজের উপর নীরবতার কম্বল টেনে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মাঝে মিষ্টি গানের সুর লাজিনার মায়ের কানে ভেসে উঠল কিন্তু ততক্ষণে তার মাথায় আরেকটি কথা ঢুকে গেছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস তার কানে পৌঁছল। লাজিনার মা গান শুনছেসে তার সমস্ত ইচ্ছা শক্তি দিয়ে তাতে মনোযোগ করছিল।

রাতের নিস্তব্ধতায়, নিঃশ্বাসের শব্দ যেন শেষ বিন্দুর মতো ঘণ্টায়বেজে উঠতে লাগল। লাজিনার মা তৃপ্তি নিয়ে বসলেন, যেন  একটি  ক্লান্ত ঘোড়া নিঃশব্দে  এসে লণ্ঠনের পাশে দাঁড়াল। এরপর সওয়ার নামলেন, ঘোড়াকে চাপ দিলেন এবং জানালার দিকে তাকালেন। জানালার ফাঁক গলিয়ে  ভিতরের ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।

এরপর সে শীতার্ত রাতের গুণ্ঠিত হাত খুলে পকেটে হাত দিয়ে  দেখতে পেল তার কাছে সাড়ে তিন টাকা আছেযার মধ্যে তিনি এক টাকা এবং চার আনা নিজের জন্য আলাদা করে রেখে এবং বাকিটা তিনি ঘোড়ার সিটের কুশনের নীচে লুকিয়ে রাখলেন। অতঃপর সে পতিতালয়ে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল — 

লাজিনার মাদরজা খুলতে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন -- 

সেই কোচম্যান — মাধোভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে চান্দো সুনিয়ারিকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে , কানে  বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন — 

"আল্লাহ জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি! যৌবনে তোমার সাথে দেখা হলে আমার ঘোড়া আর গাড়ি অনেক আগেই বিক্রি হয়ে যেত"  বলে তার হাতে এক টাকা গুঁজিয়ে দিলেন। 

চান্দো সুনিয়ারি জিজ্ঞেস করল, ‘এটুকুই কী?' 

'এটাও নাও,' এবং  এবার সে তার অন্য হাতে সাথে থাকা বাকি চার আনাও দিয়ে — ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অস্ফুট স্বরে  বলল  তোমার জীবনের শপথএইটুকুই আমার কাছে আছে।

ঘোড়াটা শীতের রাতে জমে আছে ভিতরে, আর মৃদুভাবে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘোড়াটি। এবং তার খুঁটির উপরে  রাখা লণ্ঠনটি আগের মতোই নিভে গেল। অন্ধকার — হিস হিস শব্দ --- 

মাধো লোহার খাটের উপর শুয়ে আছে, ক্লান্ত! পৃথিবীর কাছে মৃত যেন। তার পাশেই চন্দো সুনিয়ারি চোখ মেলে শুয়ে রইল,গলিত মোমের ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল, যেগুলো স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে ছোট ছোট দুধের বল হয়ে জমে গেছে। হঠাৎ মাধো, সে তার বিছানা থেকে উঠে এসে লাজিনার বিছানার পাশে গিয়ে বসল। মোমের ফোঁটায় লাজিনার বুক কেঁপে উঠল। চন্দো সুনিয়ারি ঝাপসা চোখ দেখছে কেউ যেন ছোট্ট লাজিনার সদ্য ফুটে উঠা শিমুল কাঁটার ন্যায় বক্ষ যুগল উপড়ে ফেলতে চাইছে  --  ঠিক যেন নিজের শৈশবে জমাট বাঁধা অশ্রুর ফোঁটার মধ্যে লুকিয়ে  থাকা কাহিনীর পুনরাবৃত্তি সে দেখছে। চন্দো সুনিয়ারি  কাঁপা কাঁপা হাত তুলে ছিঁড়ে ফেলল

লাজিনার গলা থেকে মোমের পুঁতি — । 

সুতোটি ছিঁড়ে গলিত মোমের পুঁতিগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়; পাথরের আলিঙ্গনে ঘুমিয়ে যায় চন্দো সুনিয়ারি। এখনঘরটি কেবল শান্ত নয়অন্ধকারও হয়ে উঠেছে-- আলোর চাইতে আঁধার  এখানে ঢের ভালো লাগে । 

 

সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০২২

কাপুরুষ (COWARD)

                                       

                                                                      মূলঃ  Sadat Hasan Manto 

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]

দিকে সাভার, ওদিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লী; মাঝখানে প্রমত্ত পদ্মা নদী। শীতের সকালে বেড়িয়ে পৌঁছালো সেই গোধূলি বেলায়,ভাবছিল রাতের কাম দিনেই শেষ করে সাভারে ফিরবে সন্ধ্যা বেলায়।তা আর হয়ে উঠল না তার। পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অভ্যাস মতো যানজট আজকে তাকে এখানে নিয়ে আসল প্রায় ৫ ঘণ্টা পর। গাড়ী থেকে নেমে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনে আগুন দিলো তাতে; একটু এগিয়ে যেতেই সে বাঁশের পুলটা দেখতে পেল। না এবারই প্রথম নয়। এখানকার ঘরগুলো, রাস্তা, এমনকি ল্যাম্প পোস্টের বাল্বগুলোও তাকে চিনতে পারে, যদি না পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের বদলিয়ে থাকে; ভাবছে ধীরে ধীরে এগুবে সে। খালের ধারে মাঠটি পরিষ্কার আর ফাঁকা আছে, শীতের গোধূলি তাই হাল্কা কুয়াশা পরছে বলে মনে হয়। ডঃ জারিফুর রহমান পি এইচডি, একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে হন হন করে হেঁটে বাঁশের সাঁকোটি পার হতে না হতেই, হাতের সিগারেটটিকে পায়ের তলায় পিষিয়ে মারল, যেভাবে সে নিজের বিবেক, নীতি,মূল্যবোধ,আর চরিত্রকে পিসে ফেলেছে ৫০ বছর আগে। এ জন্যই কেউ কেউ তাকে জাউরা জারিফ বলে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যে; ডঃজারিফ নিশ্চিত যে মিউনিসিপ্যালিটির ল্যাম্প পোস্টে লাগানো বৈদ্যুতিক বাতিটি তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে। সে দেখতে পেলো একটা খোলা উঠান— ভাগাড়ও বটে, কত শিশু! হয়তো এরাও আজ আমার মতো খয়রাতি টাকায় পি এইচ ডি করে নামের আগে ডঃ আর পিছে পি এইচ ডি লিখতে পারতো! যাকগে। সে এগুতে লাগলো ; পাতলা, মোটা , হাল্কা অথবা ভারী নিতম্বের নারীরা এখানে, ওখানে শুয়ে আছে কেউ বেঞ্চে, কেউ খাটে। নানা জন, নানা বর্ণ, হরেক রকম সাজ,ক্রিস-ক্রস ফ্যাশনে পাকা, সামনে এবং শুয়ে আছে – যেন সাদা কালো ভুবন থেকে দূরে আরেক রঙ্গিন জগতে আসলো। সে উঠোন পেরিয়ে কোণার বাড়িতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু সেই বাল্বটি যেটি তার অস্পষ্ট সূঁচ-তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার সংকল্পকে নড়বড় করে দিল এবং সে কয়েক পা দূরে বড় বাড়ীটি হতে; এ বাড়ীর পাশেই একটি ছোট নর্দমা। এ নর্দমা দিয়েই পৌর কর্তৃপক্ষ যৌন পল্লীর নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধরে রাখছে। নর্দমা পেরিয়ে উঠান পার হতে মাত্র কয়েক কদমের ব্যাপার। তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়ীটি।
জারিফুর রহমান সেই সাভার হতে যানজটের তীব্র যন্ত্রণা পেরিয়ে কিন্তু এখানে পৌঁছে গিয়েছিল। তার চিন্তা,তার পদক্ষেপের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছিল। চলতি পথের মাঝে অনেক কিছুতেই তার মন বসছে না। না সে কোন অস্থির প্রকৃতির মানুষ নয়। সে খুব ভাল করেই জানত যে সে একজন পতিতার কাছে যাচ্ছে এবং কেন সে তার কাছে যাচ্ছে তা সে আরও ভালভাবে জানতো।
তার দরকার একজন নারী—একজন নারী, তা সে যে ধরনের নারীই হোক না কেন— বুড়ি, ছুড়ি, কচি, ডিভোর্সি , মোটা,কালো, ফর্সা। একজন নারীর প্রয়োজন হঠাৎ করে দেখা দেয়নি; এটিই তার বর্তমান রূপ; না পাওয়া পর্যন্ত সদা তৎপর থেকেছে – বাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কর্মক্ষেত্রেও সে সুযোগ্কে হাত ছাড়া করেনি। হঠাৎ, কেন জানি তার মনে হল যে সে আজ একজন মহিলা ছাড়া আর একটি মুহূর্তও বাঁচতে পারবেন না। এমনটা মনে হলেই সে প্রমত্ত পদ্মা পাড়ি দিয়ে এখানে চলে আসে। তাকে অবশ্যই একজন মহিলা পেতে হবে – এমন একজন মহিলা, যার ঊরুতে সে হালকা থাপ্পড় মারতে পারবে, যার কণ্ঠস্বরে সে শুনতে পাবে যৌনতা, এমন একজন মহিলা, যার সাথে সে সবচেয়ে অশ্লীলভাবে কথা বলতে পারবে।
জারিফ একজন শিক্ষিত, বিচক্ষণ ধরনের মানুষ; চাকরি করেন। সে অধিকার-অন্যায় জানে।কিন্তু এ বিষয়ে আর ভাবতে পারছিলনা। তার গভীরে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল; এটা কোনোভাবেই নতুন ইচ্ছা ছিল না। এটি এর আগে বেশ কয়েকবার মাথা চাড়া দিয়েছিল এবং প্রতিবার তার পক্ষ থেকে অসংখ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও হতাশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। পরাজিত হয়ে, সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে সে একজন নারী না পাওয়া পর্যন্ত সন্ধান চালিয়ে যাবে।সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল এবং কোন একদিন দেখা যাবে যে সে একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা কোনও মহিলার উপর আক্রমণ করে বসতে পারে; ঠিক যেমন একটি পাগলা কুকুর যে কোনও পথচারীকে কামড়াতে পারে।
এতক্ষণে সেই প্রতিচ্ছবি তার মন থেকে চলে গেছে – একজন মহিলার প্রতিমূর্তি যার ঠোঁটে, সে ভেবেছিল, সে ফুলের উপর প্রজাপতির মতো করে নিজেকে বিশ্রাম দেবে। এবার সে তার গরম ঠোঁট দিয়ে সেই ঠোঁটগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে চাইল। মহিলার কানে মিষ্টি কিছু বকবক করার চিন্তাও তাকে এতক্ষণে ধরে বসেছে। সে জোরে কথা বলতে চেয়েছিল- যা নগ্ন ছিল।
এখন তার মনে একক, সম্পূর্ণ একটি সেক্সি নারী। সে এমন একজন মহিলাকে চায় যাকে দেখতে সেক্সি মনে হয়। সে আসলে এমন একজনকে খুঁজছিল সে হবে অর্ধেক মহিলা এবং অর্ধেক পুরুষ ।
একটা সময় ছিল যখন জারিফ ‘নারী’ শব্দটি মুখে নিলেই তার চোখে এক বিশেষ ধরনের আর্দ্রতা অনুভব করত, বিশেষ অঙ্গে ভেজা অনুভব করতো; যখন নারীর কথা ভাবলেই সে আনমনা হয়ে যেত। সে উচ্চারণ করত – ‘নারী’ – অত্যন্ত যত্ন সহকারে, যেন এই নিষ্প্রাণ শব্দটি অসতর্ক উচ্চারণে ভেঙে যেতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে সে এই নির্ভেজাল আনন্দটি উপভোগ করে চলেছে আজ অবধি।
জারিফ এবার স্বপ্নের জগৎ ছেড়ে বাস্তবে। অনেক দিন ধরে সে তার এলোমেলো চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু এখন তার শরীর ভয়ানকভাবে জেগে উঠেছে। তার কল্পনার দ্রুততা তার শারীরিক সংবেদনগুলিকে অনুভূতির এমন সূক্ষ্ম অঞ্চলে পরিণত করেছিল যে, জীবন তার জন্য সূঁচের বিছানায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি চিন্তা এক একটি বর্শায় পরিণত হয়েছে এবং কল্পিত মহিলাটি এমন একটি আকৃতি ও রূপ ধারণ করেছিল সে চাইলেও, তার বর্ণনা করা কঠিন ছিল।
জারিফ একসময় মানুষ ছিল; কিন্তু এখন সে মানুষকে ঘৃণা করে, এতটাই যে সে নিজেকেও ঘৃণা করে এখন। আর সেজন্যই সে নিজেকে এমনভাবে হেয় করতে চায় । সে বলে উঠে — “আমি নিজেকে পরিমার্জনা করতে ব্যর্থ হয়েছি, কারণ আমার চারপাশেই নোংরা। আমি এখন এই ময়লা দিয়ে আমার দেহ ও আত্মার প্রতিটি পরমাণু এবং ছিদ্র ধ্বংস করতে চাই। আমার নাক, যেটা একসময় সুগন্ধের খোঁজে বেড়াতো এখন সেটা দুঃগন্ধ শুঁকবার আশায় কাঁপছে। আর তাই আজ পুরানো চিন্তার চাদর ত্যাগ করে এই পাড়ায় চলে এসেছি, যেখানে সব কিছু একটা রহস্যময় দুর্গন্ধে ঢেকে আছে। এই পৃথিবী ভয়ংকর সুন্দর! আমি এখানেই স্নান করবো ।”
বাতির আলোয় জারিফ ধান্দার চোখে উঠানের দিকে তাকাল। দেখে মনে হয়েছিল যেন বেশ কিছু নগ্ন মহিলা সেখানে শুয়ে আছে-কারো খোলা পিঠ, অন্যরা মুখ নিচু করে; এলো মেলো শাড়ি আঁচল, অন্তর্বাস খুল্লাম খুলা ।সে সংকল্প করল কোনমতে মাঠ পেরিয়ে কোণার বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির বাল্বটি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে এগুবার সাহস না পেয়ে পিছিয়ে গেল এবং থমকে দাঁড়ালো। ব্যর্থ হয়ে ভাবতে লাগলো —“ বাতিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? কেনইবা আজ পথে পথে পাথর ছড়ানো।“
সে জানত যে এটি তার কল্পনার ছবি এবং বাস্তবতার সাথে এর কিছুই মিল নেই। তবুও, সে পিছু হটল এবং সে তার মাথার সমস্ত কুৎসিত চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলার জন্য নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল যে যে বিগত পঞ্চাশ বছরের এই দ্বিধা যা তাকে উত্তরাধিকার হিসাবে দান করা হয়েছিল সেটা আজ বাতির মধ্যে ঢুকে গেছে। সেই সঙ্কুচিত দ্বিধা, যা সে ভেবেছিল সেই ফেলে আসা দ্বিতীয় চামড়ার মতো বাড়িতে রেখে আসা মুখোশ, তার আসার অনেক আগেই এখানে পৌঁছে গেছে –এখানে সে তার জীবনের সবচেয়ে নোংরা খেলা খেলতে চলেছে। এমন একটি খেলা যা তাকে পতিতাদের বিসটা দিয়ে ঢেকে দেবে এবং তার এ দিয়েই তার আত্মাকে করে ফেলবে পুত -পবিত্র ?
এই বাড়িতে এক মধ্য বয়স্ক মহিলা বাস করে ।সে সকল সময় কালো চশমা পরে থাকে; তার সাথে চার-পাঁচজন যুবতী থাকে , এরা রূপের পসরা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে – তা দিনের আলোতে হোক বা রাতের অন্ধকারে। এই মহিলারা সারা দিন রাত মেশিনের মতো কাজ করে। এক বন্ধু জাউরা জারিফকে তাদের কথা বলেছিল, সেখানে অসংখ্যবার প্রেম ও সৌন্দর্যের লাশ দাফন করতে দেখেছে সে। বন্ধুটি জারিফকে বলত, “যখনই আমি একজন মহিলার প্রয়োজন অনুভব করি তখনই আমি দৌলতদিয়ার পতিতালয়ের সবচেয়ে পছন্দের সঙ্গী খুঁজে পাই। ঈশ্বরের কসম, এখানকার নারী যেন নারী নয়; এক একটা ডানা কাঁটা —-! আল্লাহ যেন তাকে কেয়ামত পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখেন!”
চার-পাঁচজন নারীর মধ্যে জারিফের মনে বিশেষ কোনো কিছু নাই। “আমি কোনটা পাব তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি নগদ টাকা তুলে দিবো আর বিনিময়ে দু দণ্ড শান্তি নিয়ে সাভারে ফিরে যাবো! … একজন মহিলাকে আমার হাতে তুলে দিলে , আমার এক সেকেন্ড বিলম্ব করা উচিত নয় । কোন অলস সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পরা উচিত। সামান্যতম ভদ্র কথোপকথনও নয়। ধরো তক্তা, মারো পেরেক অবস্থা।“
অস্থির হয়ে ওঠে ডঃ জারিফ। তার মধ্যে একটা কোলাহল ওঠে। সে এখন এতটাই দৃঢ়ভাবে মনস্থির করে ফেলেছে যে, যদি পাহাড় তার পথ বন্ধ করে দেয়, সেগুলিও সে ডিঙ্গিয়ে ওই বাড়িতে যাবে। কিন্তু মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের লাগানো বাতি, যা বাতাসের স্বল্প ঝাঁকুনিতে ছিঁড়ে যেতে পারে, সেই বাতির আলো তার সামনে একটি অপ্রতিরোধ্য বাধা হয়ে দাঁড়ালো। জারিফুর রহমান, নিজের লালিত অভ্যাস মতো পৌর কর্তৃপক্ষকে গালাগাল দিতে না দিতেই বাতিটি যেন প্রতিধ্বনি করতে লাগলো – “জারিফ তুই একটা খবিশ?”
সে দেখতে পেলো পাশেই একটা পানের দোকান খোলা। আলো ছিল। নগ্ন বাল্বের আলোর চারপাশে মাছিগুলো ভনভন করে যেন তাদের ডানাগুলো আগুণখেকো হয়ে গেছে। জারিফ মাছিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখার পর তার জ্বালা যেন বেড়ে গেল। ‘এটা করার’ সংকল্প, যা নিয়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। বারবার সেই মাছিগুলির সাথে পরস্পরের সংঘর্ষের ধাক্কা তাকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে তার মাথার ভিতর একটা ঝড় বয়ে যেতে থাকে। “আমি ভয় পাচ্ছি… আমি আতঙ্কিত… আমি আলোকে ; বাতিকে ভয় পাচ্ছি… এটা আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে ! আমি কাপুরুষ… আমি কাপুরুষ… আমার লজ্জিত হওয়া উচিত আমার নিজের জন্য।“
জীবনের কিছু চিহ্ন তখনও জারিফুর রহমানের সামনে, অর্থাৎ অন্য দিকে দৃশ্যমান ছিল পতিতালয়ের দোকানগুলোর উপরে সারিবদ্ধভাবে যৌনশিল্পীদের ঘর খানিকটা খালের ওপাশে। সরাসরি তার সামনে, একটি কালোমতন মহিলা একটি জানালার পাশে বসে একটি বৈদ্যুতিক আলোর তীক্ষ্ণ ঝলকানিতে নিজের উন্নত বক্ষ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। একটি নগ্ন বাল্ব সরাসরি বেশ্যার উপরে ঝুলছে এবং ঠিক যেন আগুনের একটি সাদা-গরম বলের মতো দেখাচ্ছিল যা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এবং জারিফুরের মাথার উপর দিয়ে গলে গলে পরছে ।
জারিফ সেই কালো মহিলার কথা গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করছিল যখন সে বাজারের দূরপ্রান্ত থেকে কিছু মোটা কণ্ঠস্বর সবচেয়ে অশ্লীল শ্লোগান শুনেছিল সে দাঁড়িয়ে ছিল বটে কিন্তু ওই প্রান্তটি তার কাছে দৃশ্যমান ছিল না। কিন্তু অশ্লীল কিছু শব্দ আর গালাগাল কানে এসেছিল।
জারিফ এখন নিজেকে আগের চেয়ে বেশি তুচ্ছ মনে করতে লাগলো। “তুমি… তুমি… তুমি… তুমি কী? আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি … সব পরে, তুমি কি? তুমি এও নও ,ওটাও নও… তুমি মানুষও নও, জানোয়ারও না… তোমার শিক্ষা, তোমার পি এইচ ডি, তোমার বুদ্ধি, তোমার ভালো থেকে মন্দ বলার ক্ষমতা- সবই নষ্ট হয়ে গেছে। দেখ , তিনজন মাতাল লোক আসে। তোমার মত নয়, তারা কোন স্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আসেনি। কিন্তু কোন ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই, তারা বেশ্যার সাথে কথা বলে, তারা হাসে, তারা খুনসুটি করে এবং তারা আমার খাদে উঠে যায় ,আমার নদীতে সাঁতার কাটে ইচ্ছেমত; যেমন সহজ … যেন তারা একটি ঘুড়ি উড়াতে যাচ্ছে। আর তুমি… তুমি… তুমি…. ভালো করেই জানো, তোমার কী করা উচিত, বাতির ভয়ে বাজারের মাঝখানে স্টুপিডের মতো দাঁড়িয়ে থাক! তোমার ইচ্ছা ,এতই পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ, তবুও তোমার পা তোমাকে এগিয়ে নিতে অস্বীকার করে… তোমার লজ্জা!’ এটা তোমার কাপুরুষতা।“
পতিতার এমন খেদোক্তিতে এক মিনিটের জন্য নিজের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা তার মধ্যে জেগে উঠল। তার পা কেঁপে উঠল এবং সে সরে গেল, এক লাফে নর্দমা পার হয়ে পতিতালয়ের দিকে যেতে লাগল। সে সিঁড়িতে উঠতে চলেছে এমন সময় একজন লোক নেমে আসছে। জারিফ দ্রুত পিছিয়ে গেল। সে নিজেকে আড়াল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা লোকটি তাকে কোনও কর্ণপাত করলো না ।
লোকটি তার মূল কুর্তা খুলে তার কাঁধে রেখেছিল। তার ডান হাতের কব্জিতে সুগন্ধি। ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে। জারিফের অস্তিত্ব অস্বীকার করে লোকটি উঠান পেরিয়ে নর্দমা লাফিয়ে চলে গেল। জারিফ ভাবতে লাগলো কেন লোকটা তার দিকে একবারও তাকালো না।
এদিকে, সে বাতির দিকে যেই তাকাল অমনি প্রতিধ্বনি শুনতে পেলো— “তুমি কখনই তোমার পরিকল্পনায় সফল হবে না কারণ তুমি কাপুরুষ। তোমার কি মনে আছে, গত বছর, যখন তুমি তোমার সহকর্মীটিকে বউ ঘোষণা করেছিলে, মেপেছিলে শরীরের ভাঁজ, কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই তোমার শরীরের প্রতি আউন্স শক্তি কেমন করে হারিয়ে গিয়েছিল? তুমি কতটা ভয় পেয়েছিলে? ক্যান্টনমেন্ট এ ডেটিং করতে গিয়ে এমপি পুলিশের কাছে থতমত খেয়ে ভয়ে কাপড় ভিজিয়েছিলে কিংবা তোমারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পরে তুমি সাহস দেখাতে পারনি? মনে আছে? সেই চিন্তা কীভাবে তোমাকে ভয় দেখিয়েছিল? তুমি ভয় পেয়েছিলে? আজ আমি দেখব, তুমি সিঁড়ি বেয়ে কিভাবে উপরে উঠো … আমি দেখব তুমি কিভাবে সাহস যোগাও।“
জারিফের সংকল্পে যা কিছু ছিল তা নিমিষেই উবে গেল। তার মনে হতে থাকে যে সে সত্যিকারের প্রথম শ্রেণীর একজন কাপুরুষ। অতীতের ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে একে একে ।তার মন, বইয়ের পাতার মতো একটা তীব্র দমকা হাওয়ায় এবং প্রথমবারের মতো সে সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলো যে তার অস্তিত্বের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অস্থিরতা লুকিয়ে রেখেছে এবং এটি তাকে করুণ কাপুরুষে পরিণত করেছে।
সিঁড়ি দিয়ে কারো নামার শব্দ জারিফুর শুনতে পেলো । সে কেঁপে উঠলো। একটি মেয়ে যে রাতেও কালো চশমা পরেছিল এবং যার সম্পর্কে সে তার বন্ধুর কাছ থেকে অনেক কিছু শুনেছিল। জারিফ ঘাবড়ে গেল। সে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো; মেয়েটির দরাজ কণ্ঠে জারিফ ভড়কে গেলো , “তুমি, ওখানে কেন সোনা , একটুও … ভয় পেওনা, আমার ভালোবাসা… এসো… এসো ।“ সে এবার জোরে ডাক দিল, “এসো… এসো।“
সে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো , আবার শুনতে পেলো , “এসো, আমার প্রিয় সোনা, এখন এসো।“
জারিফ দৌড় দিলো আতংকগ্রস্থ হয়ে। লাফিয়ে নর্দমা পার হতে গিয়ে, সে নর্দমার মাঝখানে উপুড় হয়ে পরে গেলো;পুরোমুখ পতিতাদের মলমূত্রে ভরে গেলো।

রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২

হুজুরের বয়ানগুলো বদলে গেল কেন-২?

 

উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন - 'লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি ("If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।" ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও , দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন - আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব - কে বড় ছোট গল্পকার — আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!
প্রসঙ্গটি মান্টো নন; বয়ান। আমরা এই সময়ে বয়ানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরাই কি বয়ান নির্ভর সমাজ বিনির্মাণের সুযোগ করে দেইনি? নির্বাচিত কয়েকটি ঘটনা দেখুন-
১। ১৯৯৯- কিংবা ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের খুতবায় বলা হচ্ছে - জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান কে জাতির পিতা বলা যাবে না ? সাহসও বটে, তবে যুক্তি শূন্য। বয়ানের সময় এক ছাত্রনেতা জিজ্ঞাসা করেন - কায়েদ এ আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বা কামাল আতারতুক - তারাও তো জাতির পিতা বলে তাদের দেশে পরিচিত ? হুজুর আর কথা বলেন না।
২। বয়ানকারি হুজুরদের আমি কাছে পেলেই জানতে চাই— গীতা পড়েছেন, বেদ পড়েছেন? বাইবেল ? ত্রিপিটক ? মহাভারত / রামায়াণ ? পৃথিবীর সকল গ্রন্থ আপনি পড়তে পারবেন না ; তাই বলে কি প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর প্রধান ৩/ ৪ টি গ্রন্থ পড়বেন না? যাদের পড়ার কথা, তারাই( শিক্ষক সমাজ) পড়েন না! হুজুররা আর কি পড়বে ? এভাবেই আমরা তারাপদ রায়ের সেই " আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে" বিখ্যাত কবিতার বাস্তব রূপ দিয়ে গেছি , ক্রমান্বয়ে ? তাই আজ একদল মজে হামলায়, তো অন্য দল দেশছাড়ার গোঙ্গানিতে । স্বদেশ ভূমি ত্যাগের কি নির্মম যন্ত্রণা, সেটা শুনেছি ১৯৭১ এর বাবার অভিজ্ঞতায়, শরণার্থী শিবিরে অভুক্ত মধ্যবিত্ত যুবকের হা হা কার! আর ২০০১ নির্বাচন উত্তর এ পরিবারের সবাই যখন ভারত যাওয়ার পক্ষে, বাবা তখনো 'না ,না' করে গেছে । আত্মীয়দের মধ্যে যারা গেছেন ছিলেন বনেদি, ওখানে আজ তারা অনেকটাই ফকির। ঘর পোড়ার কি নিদারুণ কষ্ট, যারা আলু পোড়া খায় তারা কি জানে, বুঝে সেটা ??
৩। আমরা হুজুরদের বয়ান শুনি, বিজ্ঞান ভিত্তিক কিনা, যুক্তিসম্মত কিনা জানতে চাই না; বরং প্রতিবাদ না করে , এড়িয়ে চলতে গিয়ে আমরা এমন একটি সমাজ এ দাঁড়িয়েছি, এখন বয়ানগুলো ধরে নিয়েছি বিনোদন এর খোরাক [ একাধিক পিএইইচডি গবেষক বলেছেন, পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে yt এ তাদের বয়ান শুনে, হাসি আর ঘুম তাড়াই ] অথচ এগুলো আমাদের চিন্তা, চেতনা আর যুক্তি চর্চার হাতিয়ার হতে পারতো।
৪। আপনি ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কেন আল-কিন্দি, আল ফারাবি পড়বেন না আল-বিরুনি ? কেন এবং কিভাবে মধ্য প্রাচ্যের দর্শন প্রচার করতে গিয়ে ভারতীয় দর্শন এর সমন্বয় ঘটান ; অনুবাদ করেন পতঞ্জলি বা ' ভারত তত্ত্ব' এর মতো মতো বই। আজগুবি তত্ত্ব, তথ্য দিয়ে,রাষ্ট্র শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করাই ধর্ম শক্তির কাজ নয়। আপনাকে পড়তে হবে; এক এবং একমাত্র গ্রন্থ নয় বরং বহুধা বিভক্ত মতবাদের উপর লিখিত গ্রন্থগুলো। যদি আপনি না পড়তে চান, প্রতিবাদ না করেন আপনার শোনা আজগুবি বয়ান, তাহলে ধরে নিতে হবে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে খাপ খাওয়াতে অক্ষম।ধর্ম বিজ্ঞান হতে পারে কিনা বিতর্কের বিষয় কিন্তু একে আপনাকে টেকনিক্যাল বিষয় হিসাবে মানতে হবে ; আর এখানেই সমস্যা শুরু । কারণ নন-টেকনিক্যাল লোকজনরাই টেকনিক্যাল কথা বলে আর সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলে। আর সুবিধা নেয় অন্যজনেরা।
উত্তরণের উপায় কী? রামানুজন মনে করেন — আমাদের এই উপমহাদেশের একটি নিজস্ব পন্থা ও দর্শন আছে, সেঁটা অনুসরণ করতে হবে (Is there an Indian way of thinking, 1989)।সেই সুবাদে কমলকুমার মজুমদারের মতো আমিও আশাবাদী— "ক্রমে আলো আসিতেছে" ( অন্তর্জলি যাত্রা)।

রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২

শব্দের নগ্নতা

ব্দের  নগ্নতা

মূলঃ সাদাত হাসান মান্টো (Naked voice)

ভোলু আর গামা দুই ভাই । দু’জনেই ছিলেন খুব পরিশ্রমী। ভোলু সারাদিন গ্রামের এ পাড়া -ও পাড়া ঘুরে হাড়ি পাতিল কেনা-বেচা করার পাশাপাশি মেরামতেরও কাজ করে বেড়ায়। রোজ সকালে মাথায় ছোট্ট একটা টুকরি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় । সে গ্রাম কিংবা শহরের রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়াতো এবং লোকজনকে তাদের পুরাতন থালা-বাসনগুলো মেরামত বা বিক্রির করার সাথে নতুন থালা বাসন কেনার জন্য লম্বা করে হাঁক ছাড়ত । প্রতি সন্ধ্যায় যখন সে বাসায় ফিরে আসত তখন তার পকেটে বেশ ভালোই টাকা থাকত ।
গামাও একজন ফেরিওয়ালা। সেও মাথায় ঝুড়ি নিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। সেও প্রতিদিন ভালোই রোজগার করে , কিন্তু মদ্যপানের অভ্যাস ছিল তার। প্রতি সন্ধ্যায় তার সন্ধ্যার খাবার কেনার পর তাকে দেশীয় মদ কিনে গিলতে হতো। মদ তাকে মাতাল করে ফেলে, এতে সে যাছেতাই ব্যবহার করে । সবাই জানত যে গামা মদ পান করার জন্যই বেঁচে আছেন ।
ভোলু তার দুই বছরের বড় ভাই -গামাকে বোঝানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতো এই বলে যে - মদ্যপান একটি ভাল অভ্যাস নয়; তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ; তোমার বউ আছে ? তুমি কেন টাকা নষ্ট কর? তুমি প্রতিদিন মদ খাওয়ার জন্য যে টাকা নষ্ট কর, তা জমা করলে তোমরা আরও ভাল জীবনযাপন করতে পারো ;তুমি কি চোখে দেখতে পাওনা যে – তোমার বউ সেই ছেঁড়া -ন্যাকড়া পরে অর্ধনগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মজার বিষয় হল — ভোলুর কথা গামার এক কানে ঢুকে, অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। শেষ পর্যন্ত ভোলু ত্যাক্ত- বিরক্ত হয়ে এ বিষয়ে তার সাথে কিছু বলা বন্ধ করে দিল।
যা হোক – দু’জনেই শরণার্থী ছিলেন। তারা একটি পরিত্যাক্ত বড় দালান খুঁজে পেয়েছিল যেখানে তারা ভবনের একটি ফ্লোরে কোন রকম মানবেতর জীবন যাপন করতো ; কেননা গনরুমে কোন রকম কাপড়ের পর্দা তুলে রুম বানিয়ে এরা সবাই বসবাস করতো।
স্বাভাবিক গতিতেই শীতকাল খুব সহজে চলে গেল কিন্তু গ্রীষ্ম এলেই দরিদ্র গামার জীবন কঠিন হয়ে গেল। ভোলু ছাদে খাট বিছিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করে ফেললো; কিন্তু বেচারা গামা? তার স্ত্রী ছিল এবং উপরের তলায় কোন প্রকার পর্দার ব্যবস্থা ছিল না। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি গামার সাথে অন্য বাসিন্দাদেরও করতে হতো । এই ভবনের বসবাসকারী সকল বিবাহিত পুরুষের একই ধরনের সমস্যা হতে লাগলো।
একদিন প্রতিবেশী কালান একটি অভিনব ধারণা নিয়ে এলেন। সে তার খাটের চারপাশে চটের পর্দা দিয়ে এক ধরনের বেড়া তৈরি করল । যাতে করে স্বামী-স্ত্রী গোপনীয়তা কিছুটা হলেও রাখ ঢাক থাকে।এটি ছাদের উপরে জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে উঠল বিশেষ করে দম্পতিদের ক্ষেত্রে। এভাবে, অন্যরা তাদের স্ত্রীদের সাথে ভাগ করে নেওয়া বিছানার চারপাশে একই ধরনের পর্দা স্থাপন করেছিল। ভোলুও তার ভাইকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেল এবং কয়েক দিনের মধ্যে দু’ জনে বাঁশ খুঁড়ে পাটের বস্তা এবং পুরানো কম্বলের পর্দা তৈরি করল। যদিও এটি সত্য ছিল যে পর্দাটি বাতাসকে অবরুদ্ধ করেছে বটে কিন্তু শব্দের নিয়ন্ত্রণ এই পর্দা নিতে পারেনি তবুও এটি ভবনের নীচের গরম -যন্ত্রণা থেকে ঢেঁড় ভালো ছিল।
ছাদে ঘুমানোর ফলে ভোলুর চরিত্রে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। এখন পর্যন্ত, সে বিয়েতে খুব বেশি বিশ্বাসী ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে কখনই বৈবাহিক ফাঁদে পড়বে না। গামা যখনই তার বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করত, সে সর্বদা বলত, 'না ভাই, আমি অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা করতে চাই না।' কিন্তু গ্রীষ্মের আগমন এবং দশ বা পনেরো দিন ছাদে ঘুমানোর সাথে সাথে সে তার মন পরিবর্তন করল. একদিন সন্ধ্যায় সে তার ভাইকে বলল, 'আমাকে বিয়ে করে দাও না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।'
গামা জিজ্ঞেস করল 'এটা কোনো ধরনের রসিকতা?'
কিন্তু ভোলু আরও গম্ভীর হয়ে বলল, 'তুমি জানো না... আমি পনেরো রাত জেগে আছি।' শব্দের জ্বালায় একটুও ঘুমাতে পারিনা।
গামা জিজ্ঞেস করল, 'কেন? কি হয়েছে?'
‘কিছুই না, শুধু বাম, ডান... সব দিকেই কিছু না কিছু ঘটছে... সব দিক থেকে অদ্ভুত আওয়াজ আসছে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কি ঘুমাতে পারে?'
গামা তার মোটা গোঁফের আড়াল থেকে মনে মনে হেসে উঠল ।
ভোলু হঠাৎ লাজুক হয়ে গেল। তারপর বলে উঠল , ‘ওই কলান , ব্যাটা নির্লজ্জ ! সে সারারাত এমন বাজে কথা বলে... আর তার সেই বউ... সে তার মতোই বেহায়া ! তাদের বাচ্চারা খাটের আশেপাশে শুয়ে আছে, কিন্তু তাদের কি সেদিকে খেয়াল আছে !'
বরাবরের মতো গামা বসে মদ গিলছিলেন । ভোলু চলে যাওয়ার পর সে তার বন্ধুদের জড়ো করে খুব আনন্দের সাথে বলেছিল যে তার ভাই আজকাল ঘুমাতে পারে না। আর যখন সে বেচারা ভোলু ঘুমাতে না পারার কারণ নিয়ে এসে তার অনবদ্য স্টাইলে কিছুক্ষণ ব্যাখ্যা করতে লাগল, তখন তার শ্রোতারা—আনন্দে গড়াগড়ি দিতে লাগল। পরের বার গামার সাথে মদ্যপানকারীরা ভোলুর সাথে দেখা হলে তারা তাকে বেসুরো নানা বিধ কথা বলে জ্বালাতন করে। একজন তো বলেই বসল, 'আমাদের বল, কালান তার স্ত্রীকে কী বলে?' আরেকজন - 'তাহলে,তুমি বিনামূল্যে মজা নাও ... তুমি সারারাত ধরে সিনেমা দেখ! ... তাও আবার এক টিকেটে দুই ছবি !' দুষ্টু -মিষ্ট কোথায় ভোলু তাদের বাজে ঠাট্টায় বিরক্ত হলেও কিছুই করার ছিলনা।
পরের দিন সে গামাকে এ জন্য গালাগালি করে বলে উঠল , 'তুমি আমাকে রসিকতায় পরিণত করেছ।আমি তোমাকে সত্যিটাই বলেছি, তা আমার কল্পনার কথা নয়। আমি তোমাকে বলছি, আমি ঘুমাতে পারি না! কুড়ি দিন হয়ে গেল জেগে আছি। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও, নইলে আমি পাগল হয়ে যাবো। তোমার বউয়ের কাছে যে টাকা আমি জমা রেখেছি... তা দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা ব্যবস্থা কর ।
গামা ভেবেচিন্তে গোঁফ পাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আজ রাতে তোমার বউদির সাথে সাথে কথা বলব এবং তাকে তার বন্ধুদের মধ্যে থেকে একটি ভালো মেয়ে খুঁজে বের করতে বলব।
দেড় মাসের মধ্যে পাত্রী পাওয়া গেল এবং বিয়ের প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্নও হল। গামার স্ত্রী হিসাবে ফেরিওয়ালা সামাদের মেয়ে আয়েশাকে সবাই পছন্দ করে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দিল। সে খুব সুন্দর মেয়ে, ঘরের কাজ জানত এবং সামাদও ভদ্র প্রকৃতির । আশপাশের লোকজন তাকে শ্রদ্ধা করত। ভোলু একটি ভাল ছেলে – সে কঠোর পরিশ্রমী এবং সুস্থ সবল যুবক। সামাদ প্রতিবাদ করেছিলেন যে তিনি গ্রীষ্মে তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না, কিন্তু গামা যখন নাছোড়বান্দা , তখন তাকে হার মানতে - হল মেয়ের বাপ বলে ।
বিয়ের চারদিন আগে ভোলু খাটের চারপাশে পাটের বস্তা দিয়ে তার কনের জন্য ব্যবস্থা করে রাখল । সে শক্ত বাঁশের খুঁটি কিনে আনে এবং নিশ্চিত হয় যে খুঁটি ও বস্তার পর্দা নিরাপদে বাঁধা আছে। ভোলু খুব যত্ন এবং বিয়ের উদ্যমে এই সব করতে লাগলো ।
প্রথম রাতে সে বস্তার পর্দার আড়ালে ঘুমাতে, সে কিছুটা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করে । সে তাজা শীতল বাতাসে অভ্যস্ত ছিল কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলো যে সে এটিতে অভ্যস্ত হবে। বিয়ের চারদিন আগে থেকেই পর্দার আড়ালে ঘুমাতে শুরু করল সে । প্রথম রাতে সে সেখানে শুয়ে তার স্ত্রীর কথা ভেবে ঘামে ভিজে গেল। ভেসে আসা শব্দও গুলো তার কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগল – অস্ফুট কণ্ঠস্বরগুলো তাকে ঘুমোতে দেয় না এবং তার মাথার মধ্যে অদ্ভুততম চিন্তার আবেশ তাকে আরও চিন্তিত করে ফেলে।
“আমরাও কি একই ধরনের নগ্ন শব্দ উৎপন্ন করব?... আমাদের চারপাশের লোকেরা কি আমাদের শব্দ শুনবে? ... তারাও কি সারারাত জেগে থাকবে; কারণ আমাদের শব্দ বা অস্ফুট স্বরও কি তাদের ঘুমাতে দেবে না? ----“
বেচারা ভোলু আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল। শুধু একটাই দুশ্চিন্তা তাকে দূরে সরিয়ে দিল: বস্তার কাপড় কি আদৌ কোন ধরনের পর্দা? চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষ; রাতের স্থিরতায় শোনা যায় সবচেয়ে ছোট পিন পতনের শব্দ। মানুষ কিভাবে এমন নগ্ন জীবন যাপন করে? একটি মাত্র ছাদ আছে মাথার উপর ; স্ত্রী - স্বামী শুয়ে থাকে এক খাটে । অগণিত চোখ-কান সব দিকেই খোলা। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও সব শুনতে পায়। ক্ষুদ্রতম শব্দ একটি সম্পূর্ণ ছবিকে জীবন্ত করে তুলতে পারে ... বস্তার পর্দা কী করতে পারে? সূর্য উঠার মুহুর্তে, সমস্ত কিছু খালি হয়ে যায় ... সেখানে কালান তার স্ত্রীর স্তন মর্দন করছেন ... সেই কোণে তার ভাই গামা রয়েছে।সব কিছুই পূর্বাবস্থায় এক কোণায় পড়ে আছে। দেখতে পাওয়া যাছে মিষ্টি দোকানদারের অবিবাহিত কন্যাটির -এর উন্মুক্ত পেট, উন্নত স্তন -- হাওয়ায় দুলছে বস্তার পর্দা ------ ফাঁক দিয়ে ------- দিচ্ছে।
বিয়ের দিন ভোর হয়ে গেল আর ভোলু মনে মনে ভাবল পালিয়ে যাবে ; সে আর বিয়ে করবে না , কিন্তু সে যাবে কোথায়? নিজের তৈরি ফাঁদে আটকা পরেছে সে ! পালিয়ে গেলে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতে হবে ! কিন্তু বেচারা হতভাগ্য মেয়েটির জন্য সমাজে এটা কী অপমান বয়ে আনবে না ! আর সবাই হৈচৈ করবে। কলঙ্কিত করবে মেয়েটিকে। অপবাদ রটাবে।
“ ঠিক আছে, বিয়ে তা আগে হোক। সবাই এটা করে। আমিও এতে অভ্যস্ত হয়ে যাব।“ ভোলু যথাসম্ভব নিজেকে সাহস জোগাতে চেষ্টা করে এবং বিয়ের দিন কনেকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল সবার মঝে। লোকেরা গামা এবং ভোলু উভয়কে অভিনন্দন আর আশীর্বাদ জানাতে লাগলো। ভোলুর কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে উত্যক্ত করার পাশাপাশি, বিয়ের রাতে তাকে দু-একটা কৌশলও বলে দিল যে বিড়াল বিয়ের রাতেই মারতে হবে। ভোলু নীরবে তাদের কথা শুনল।
গামার স্ত্রী বস্তার পর্দা বিশিষ্ট ঘরে নববধূর জন্য বিছানা বিছিয়ে দিলেন। গামা বালিশের পাশে সুগন্ধি জুঁই ফুলের চারটি বড় মালা রাখলেন। এক বন্ধু দুধে ডুবিয়ে কিছু জিলাপিও রাখল----- ।
তারা ছাদের সেই বস্তা ঘেরা ঘরে পৌঁছে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা দেখতে পেল। নববধূ বিছানার দিকে নির্দ্বিধায় হেঁটে যাওয়ার সাথে সাথে তার রূপার পায়ের গোড়ালি প্রতিটি লাজুক পদক্ষেপের সাথে কথা বলতে শুরু করল। ভোলুর মনে হল, যে ঘুমটা তাদের সমস্ত কিছুকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তা যেন জীবনের জন্য ধাক্কা খেয়েছে। লোকেরা তাদের খাটের শব্দ করতে শুরু করে দিল , কেউ কাশি এবং গলা পরিষ্কার করতে শুরু করে দিল । ফিসফিস আর গোঙানি ভেসে উঠতে থাকে উত্তাল বাতাসে। হতভম্ব হয়ে ভোলু তার বউয়ের হাত ধরে দ্রুত বস্তার পর্দার দিকে টেনে নিয়ে গেল। মৃদু হাসির আওয়াজ কানে পৌছালো। তার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। সে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেই কিন্তু চারপাশে ফিসফিসানি বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ দূরের কোণে যেখানে কালানের বিছানা, তার খাটটি হতে জোরে জোরে শব্দ আসতে শুরু করে দিল : চুর-ছু, চুর-ছু--- উঃ আঃ --- । এক সময় কালান এর খাট নিশ্তব্দ হয়ে গেলে; গামার লোহার খাট কথা বলতে শুরু করে দিল একই শব্দ , একই গোঙ্গানি ---- হিস ! হিস! --- উঃ আঃ --- ।
মিষ্টি বিক্রেতার অবিবাহিত মেয়েটি কয়েকবার জল খেতে উঠেছিল। যতবারই তার গ্লাসটি পাত্রের সাথে ঠেকেছে, ততবারই ভোলুর কানে বিস্ফোরণের মতো শব্দ হচ্ছে – যেন পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ।কসাইয়ের ছেলের খাট থেকে বারবার ভেসে আসছে ম্যাচ জ্বালানোর শব্দ। ভোলু তার নববধূর সাথে আলাপ করার সমস্ত চেষ্টা ত্যাগ করে বসে আছে। সে ভয় পেয়ে গেলো যে তার চারপাশের কানগুলি তার কথা গিলে ফেলবে এবং সমস্ত খাট চুর-ছু, চুর-ছুর! উঃ আঃ --- এর কোরাস শুরু করবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ; নিঃশব্দে শুয়ে রইল। মাঝে মাঝে, সে তার স্ত্রীর দিকে চুরি বা লাজুক ও ভীতু দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো, যে তার কাছে খাটে শুয়ে আছে । বউ কিছুক্ষণ জেগে থাকার পর ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোলু ঘুমাতে চাইলো কিন্তু পারলো না। প্রতি কয়েক মিনিটে কোনো না কোনো শব্দ তার কানে পৌছে যেত... আওয়াজের ফলে পুরো জীবন-সদৃশ ছবিগুলো প্রাণবন্ত হয়ে তার সামনে দাঁড়ায় ।
বিবাহের আশায় তার হৃদয় এমন আশা এবং এত উত্তেজনায় ভরে গিয়েছিল; যেদিন সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেদিন থেকেই তার মাথায় সেই সব উত্তেজনাপূর্ণ আনন্দের কথা গুনগুন করছিল যা অজানা ছিল। বিয়ের চিন্তা তার শরীরে এক অদ্ভুত রকমের তাপ প্রবাহিত করত, একটি সুন্দর, আনন্দদায়ক উষ্ণতা। কিন্তু এখন তার ‘প্রথম রাত’ ভাবতেই সে ঠাণ্ডা হয়ে গেল! সেই উষ্ণতা-প্ররোচিত অনুভূতিগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেই শব্দ - সেই ছবি আঁকা কণ্ঠ - সবকিছু ভেঙ্গে চুড়ে দিল । সে নগ্ন, একেবারে নগ্ন বোধ করতে শুরু করল , এবং মনে হতে লাগলো চারপাশের সকলেই তার দিকে বড় চোখে তাকিয়ে হাসছে ।
ভোর ৪টার দিকে সে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস ঠান্ডা জল পান করেন। সে একটু ভাবল। সে বউকেআঁকড়ে ধরে জমে থাকা উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করেছিলেন। একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। ভোলু কালানের দিকে ঘুরে গেল। তার বস্তার পর্দার ঝাপসা প্রান্তগুলো হাওয়ায় নড়ছে। কালান তার স্ত্রীর পাশে একেবারে নগ্ন হয়ে শুয়ে ছিল। এটা তাকে রাগান্বিত করেছিল: কেন এখন ছাদে বাতাস বইতে হবে? এবং, যদি এটা ফুঁ দিতেই হবে, তাহলে কেন এই ধরনের বস্তার পর্দাগুলোকে জ্বালাতন করতে হবে? তার মনে হল সব বস্তার পর্দা টেনে নিজের জামা কাপড় ছিঁড়ে ছাদে উলঙ্গ হয়ে নাচছে। ভোলুর বমি হতে লাগলো । ছিঃ ।
তার বন্ধুরা জেনেশুনে তার দিকে তাকিয়ে তার প্রথম রাতের কথা জিজ্ঞেস করে।, “ তাহলে, কেমন লাগলো? আশা করি, তুমি আমাদের নাম মুছে দাও নি ' ইত্যাদি ইত্যাদি । 
একটুপরে একজন ফেরিওয়ালার সাথে দেখা হলে সে রহস্যময় উপায়ে জিজ্ঞাসা করল , ‘এখানে দেখ; আমার কাছে এই দুর্দান্ত রেসিপিটি রয়েছে যা বিস্ময়করভাবে কাজ করে।'
আরেকজন তাকে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললো, 'তাহলে, আমার প্রিয় কুস্তিগীর, খেলা কেমন হলো?'
ভোলু চুপ করে রইল।
কয়েদিন পর রীতি অনুযায়ী ভোলুর বউ তার বাবা-মায়ের বাড়িতে যায়।
সে পাঁচ-ছয় দিন পর ফিরে আসে এবং আবারও ভোলু নিজেকে একই দ্বিধায় পড়ে যায়। ছাদে শুয়ে থাকা সবাই যেন তার স্ত্রীর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। গত কয়েকটা রাত শান্ত ছিল কিন্তু যে রাতে সে তার স্ত্রীর সাথে সেখানে ঘুমাতে এসেছিল, সেই রাতেই আবার একই কথা শুরু হয়: ফিসফিস আর বকবক, চুর-চু, চুর-ছু, কাশি এবং গলা পরিষ্কার করা, ঠকঠক করা। পাত্রের বিপরীতে গ্লাস, টসিং এবং ক্রি! কিং বিছানার উপর দুম দাম শব্দ! দম বন্ধ করা হাসি। ভোলু সারারাত জেগে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে, সে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলত এবং তার স্ত্রীর দিকে আকুলভাবে তাকাত , এবং বউও বিরক্ত হত। ভোলু বলতে লাগত, 'আমার কী হয়েছে? ... আমার কি কি হয়েছে? ... ওহ, আমার কি হয়েছে?'
এভাবে চলতে থাকে সাত রাত অবধি। শেষ পর্যন্ত, ভোলু তার বধূকে তার বাবা-মায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বিশ দিন কেটে গেল। গামা একদিন ভোলুকে বলল, ‘তুমি অদ্ভুত লোক! তুমি কীভাবে তোমার নববধূকে তার পিতামাতার কাছে পাঠাতে পারো ? সে তো এত দিন চলে গেছে, তুমি একা ঘুমাও কী করে?
ভোলু সংক্ষেপে উত্তর দিল, 'সব ঠিক আছে।'
গামা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ঠিক আছে? আমাকে বলো না কেন? ব্যাপারটা কি? তুমি কি আয়েশাকে পছন্দ করো না?
'এটা তা নয়।'
‘ তাহলে কোনটা ? ‘
ভোলু উত্তর দিল না। কয়েকদিন পর গামা আবার প্রসঙ্গ তুলল ভাইয়ের কাছে । ভোলু উঠে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের বাড়ির বাইরে একটি খাট রাখা হয়েছিল। সে বাইরে গিয়ে তার উপর বসল । সে তার এক আত্মীয়র গলা শুনতে পেল। সে গামার সাথে ভিতরে কথা বলছিল এবং বলছে, ‘তুমি জানো না , তুমি ভুল বলেছ ; যখন তুমি বলো যে ভোলু আয়েশাকে পছন্দ করে না।
ভোলু গামাকে জিজ্ঞেস করতে শুনেছে, ‘তাহলে কী হলো? সে আয়েশার প্রতি মোটেও আগ্রহী বলে মনে হয় না।‘
'কেন না?'
ভোলু শুনতে পেল না, আত্মীয়াটি তাকে কি বললো, তবুও তার মনে হলো কেউ যেন তার অস্তিত্ব, তার পরিচয়কে ব্লেন্ডার এর মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং তা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তারপর গামাকে জোরে বলতে শুনলেন, ‘না, না! তোমাকে সেটা কে বললো?'
গামার আত্মীয়াটি উত্তর দিল, ‘আয়শা তার এক বন্ধুকে বলেছিল... এটা আমার কাছে এক কান দুই কান হয়ে পৌঁছেছে।‘
গামা হতভম্ব ভঙ্গিতে বললেন, 'এটা ভয়ানক!'
বাইরে বসে ভোলু অনুভব করল একটা ছুরি তার হৃদয়ে ঢুকে গেছে। তার ভিতরে কিছু একটা ছিটকে পড়ল। সে ছাদে উঠে গেল। খুঁটিতে ঝোলানো সমস্ত বস্তার পর্দা সে টেনে ছিঁড়তে শুরু করল। হট্টগোল শুনে লোকজন ছুটে আসতে লাগল । তারা তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, সে তাদের সাথে মারামারি শুরু করে দিল। বিষয়টি নোংরামিতে গড়াল ।কালান একটি খুঁটি তুলে তার মাথায় জোড়ে আঘাত করে। ভোলু অজ্ঞান হয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন তিনি এসেছিলেন, তিনি তার মন হারিয়েছিলেন। জ্ঞান ফিরলে দেখা যায় – ভোলু পাগল হয়ে গেছে ?
ভোলু এখন নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর যখনই সে একটি বস্তার পর্দা দেখতে পায়, সে তাতে ধাক্কা দেয় এবং ছিঁড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে ......।