এই ব্লগটি সন্ধান করুন

রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২

হুজুরের বয়ানগুলো বদলে গেল কেন-২?

 

উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন - 'লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি ("If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।" ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও , দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন - আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব - কে বড় ছোট গল্পকার — আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!
প্রসঙ্গটি মান্টো নন; বয়ান। আমরা এই সময়ে বয়ানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরাই কি বয়ান নির্ভর সমাজ বিনির্মাণের সুযোগ করে দেইনি? নির্বাচিত কয়েকটি ঘটনা দেখুন-
১। ১৯৯৯- কিংবা ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের খুতবায় বলা হচ্ছে - জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান কে জাতির পিতা বলা যাবে না ? সাহসও বটে, তবে যুক্তি শূন্য। বয়ানের সময় এক ছাত্রনেতা জিজ্ঞাসা করেন - কায়েদ এ আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বা কামাল আতারতুক - তারাও তো জাতির পিতা বলে তাদের দেশে পরিচিত ? হুজুর আর কথা বলেন না।
২। বয়ানকারি হুজুরদের আমি কাছে পেলেই জানতে চাই— গীতা পড়েছেন, বেদ পড়েছেন? বাইবেল ? ত্রিপিটক ? মহাভারত / রামায়াণ ? পৃথিবীর সকল গ্রন্থ আপনি পড়তে পারবেন না ; তাই বলে কি প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর প্রধান ৩/ ৪ টি গ্রন্থ পড়বেন না? যাদের পড়ার কথা, তারাই( শিক্ষক সমাজ) পড়েন না! হুজুররা আর কি পড়বে ? এভাবেই আমরা তারাপদ রায়ের সেই " আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে" বিখ্যাত কবিতার বাস্তব রূপ দিয়ে গেছি , ক্রমান্বয়ে ? তাই আজ একদল মজে হামলায়, তো অন্য দল দেশছাড়ার গোঙ্গানিতে । স্বদেশ ভূমি ত্যাগের কি নির্মম যন্ত্রণা, সেটা শুনেছি ১৯৭১ এর বাবার অভিজ্ঞতায়, শরণার্থী শিবিরে অভুক্ত মধ্যবিত্ত যুবকের হা হা কার! আর ২০০১ নির্বাচন উত্তর এ পরিবারের সবাই যখন ভারত যাওয়ার পক্ষে, বাবা তখনো 'না ,না' করে গেছে । আত্মীয়দের মধ্যে যারা গেছেন ছিলেন বনেদি, ওখানে আজ তারা অনেকটাই ফকির। ঘর পোড়ার কি নিদারুণ কষ্ট, যারা আলু পোড়া খায় তারা কি জানে, বুঝে সেটা ??
৩। আমরা হুজুরদের বয়ান শুনি, বিজ্ঞান ভিত্তিক কিনা, যুক্তিসম্মত কিনা জানতে চাই না; বরং প্রতিবাদ না করে , এড়িয়ে চলতে গিয়ে আমরা এমন একটি সমাজ এ দাঁড়িয়েছি, এখন বয়ানগুলো ধরে নিয়েছি বিনোদন এর খোরাক [ একাধিক পিএইইচডি গবেষক বলেছেন, পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে yt এ তাদের বয়ান শুনে, হাসি আর ঘুম তাড়াই ] অথচ এগুলো আমাদের চিন্তা, চেতনা আর যুক্তি চর্চার হাতিয়ার হতে পারতো।
৪। আপনি ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কেন আল-কিন্দি, আল ফারাবি পড়বেন না আল-বিরুনি ? কেন এবং কিভাবে মধ্য প্রাচ্যের দর্শন প্রচার করতে গিয়ে ভারতীয় দর্শন এর সমন্বয় ঘটান ; অনুবাদ করেন পতঞ্জলি বা ' ভারত তত্ত্ব' এর মতো মতো বই। আজগুবি তত্ত্ব, তথ্য দিয়ে,রাষ্ট্র শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করাই ধর্ম শক্তির কাজ নয়। আপনাকে পড়তে হবে; এক এবং একমাত্র গ্রন্থ নয় বরং বহুধা বিভক্ত মতবাদের উপর লিখিত গ্রন্থগুলো। যদি আপনি না পড়তে চান, প্রতিবাদ না করেন আপনার শোনা আজগুবি বয়ান, তাহলে ধরে নিতে হবে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে খাপ খাওয়াতে অক্ষম।ধর্ম বিজ্ঞান হতে পারে কিনা বিতর্কের বিষয় কিন্তু একে আপনাকে টেকনিক্যাল বিষয় হিসাবে মানতে হবে ; আর এখানেই সমস্যা শুরু । কারণ নন-টেকনিক্যাল লোকজনরাই টেকনিক্যাল কথা বলে আর সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলে। আর সুবিধা নেয় অন্যজনেরা।
উত্তরণের উপায় কী? রামানুজন মনে করেন — আমাদের এই উপমহাদেশের একটি নিজস্ব পন্থা ও দর্শন আছে, সেঁটা অনুসরণ করতে হবে (Is there an Indian way of thinking, 1989)।সেই সুবাদে কমলকুমার মজুমদারের মতো আমিও আশাবাদী— "ক্রমে আলো আসিতেছে" ( অন্তর্জলি যাত্রা)।

কোন মন্তব্য নেই: