মূলঃ THE CANDLE’S TEARS, By Sadat Hasan Manto.
মোমবাতিটি স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে ছিল, দুধের হিমায়িত ফোঁটার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গলে পড়া মোমবাতির ফোঁটাগুলো। ছোট্ট মেয়ে লাজিনা হাতে একটা মুক্তার মালা নিয়ে কাঁদছিল। তার মা মোমের গলে পড়া বিন্দু/ফোঁটা দিয়ে একটি পুঁতির মালা তৈরি করে লাজিনার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। লাজিনা তার মোমের মালা গলায় পরে আনন্দে হাততালি দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাত নেমে গেল। গ্রামের একটি আধা ভাঙ্গা ঘরে মোমবাতিটি জ্বলে উঠল। এর একচোখা আলো ঘরের অন্ধকার উবে গেল এবং কিছু মুহূর্তের জন্য ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু সময় পরে, ঘরটি আবারো ভয়ঙ্কর অন্ধকার পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে গেলো, যেন একটি অবিচলিত অস্পষ্ট দৃষ্টি চারদিকে তাকাতে শুরু করে অনিশ্চয়তায় ।
ছোট্ট লাজিনা খাটের উপর দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্নে তার বন্ধু বিন্দুর সাথে লড়াই করে, এবং তাদের পুতুলের ছেলে -মেয়েদের বিয়ে দিবে না বলে তারা ঝগড়া করতে থাকে।
লাজিনার মা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ এবং ম্লান আলোকিত কাদামাখা মাটির রাস্তার দিকে আকুলভাবে তাকিয়ে ছিলেন। রাস্তার ওপারে লোহার খুঁটিতে ঝুলে থাকা একটি লণ্ঠন ডিসেম্বরের শীতের রাতে ঘুমন্ত প্রহরীর মতো নিভু নিভু। লাজিনার মা দেখছে, তার সামনে একটি বন্ধ রেস্তোরাঁ,ঘুমন্ত শহরে কুয়াশাছন্ন আকাশ,বারোটা বেজে গেলো ; সে কেঁপে উঠল, তারপর নিজের উপর নীরবতার কম্বল টেনে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মাঝে মিষ্টি গানের সুর লাজিনার মায়ের কানে ভেসে উঠল কিন্তু ততক্ষণে তার মাথায় আরেকটি কথা ঢুকে গেছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস তার কানে পৌঁছল। লাজিনার মা গান শুনছে, সে তার সমস্ত ইচ্ছা শক্তি দিয়ে তাতে মনোযোগ করছিল।
রাতের নিস্তব্ধতায়, নিঃশ্বাসের শব্দ যেন শেষ বিন্দুর মতো ঘণ্টায়বেজে উঠতে লাগল। লাজিনার মা তৃপ্তি নিয়ে বসলেন, যেন একটি ক্লান্ত ঘোড়া নিঃশব্দে এসে লণ্ঠনের পাশে দাঁড়াল। এরপর সওয়ার নামলেন, ঘোড়াকে চাপ দিলেন এবং জানালার দিকে তাকালেন। জানালার ফাঁক গলিয়ে ভিতরের ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।
এরপর সে শীতার্ত রাতের গুণ্ঠিত হাত খুলে পকেটে হাত দিয়ে দেখতে পেল তার কাছে সাড়ে তিন টাকা আছে, যার মধ্যে তিনি এক টাকা এবং চার আনা নিজের জন্য আলাদা করে রেখে এবং বাকিটা তিনি ঘোড়ার সিটের কুশনের নীচে লুকিয়ে রাখলেন। অতঃপর সে পতিতালয়ে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল —
লাজিনার মা, দরজা খুলতে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন --
সেই কোচম্যান — মাধো, ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে চান্দো সুনিয়ারিকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে , কানে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন —
"আল্লাহ জানেন আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি! যৌবনে তোমার সাথে দেখা হলে আমার ঘোড়া আর গাড়ি অনেক আগেই বিক্রি হয়ে যেত" বলে তার হাতে এক টাকা গুঁজিয়ে দিলেন।
চান্দো সুনিয়ারি জিজ্ঞেস করল, ‘এটুকুই কী?'
'এটাও নাও,' এবং এবার সে তার অন্য হাতে সাথে থাকা বাকি চার আনাও দিয়ে — ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অস্ফুট স্বরে বলল ‘তোমার জীবনের শপথ, এইটুকুই আমার কাছে আছে।’
ঘোড়াটা শীতের রাতে জমে আছে ভিতরে, আর মৃদুভাবে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘোড়াটি। এবং তার খুঁটির উপরে রাখা লণ্ঠনটি আগের মতোই নিভে গেল। অন্ধকার — হিস হিস শব্দ ---
মাধো লোহার খাটের উপর শুয়ে আছে, ক্লান্ত! পৃথিবীর কাছে মৃত যেন। তার পাশেই চন্দো সুনিয়ারি চোখ মেলে শুয়ে রইল,গলিত মোমের ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল, যেগুলো স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পড়ে ছোট ছোট দুধের বল হয়ে জমে গেছে। হঠাৎ মাধো, সে তার বিছানা থেকে উঠে এসে লাজিনার বিছানার পাশে গিয়ে বসল। মোমের ফোঁটায় লাজিনার বুক কেঁপে উঠল। চন্দো সুনিয়ারি ঝাপসা চোখ দেখছে কেউ যেন ছোট্ট লাজিনার সদ্য ফুটে উঠা শিমুল কাঁটার ন্যায় বক্ষ যুগল উপড়ে ফেলতে চাইছে -- ঠিক যেন নিজের শৈশবে জমাট বাঁধা অশ্রুর ফোঁটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কাহিনীর পুনরাবৃত্তি সে দেখছে। চন্দো সুনিয়ারি কাঁপা কাঁপা হাত তুলে ছিঁড়ে ফেলল
লাজিনার গলা থেকে মোমের পুঁতি — ।
সুতোটি ছিঁড়ে গলিত মোমের পুঁতিগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়; পাথরের আলিঙ্গনে ঘুমিয়ে যায় চন্দো সুনিয়ারি। এখন, ঘরটি কেবল শান্ত নয়, অন্ধকারও হয়ে উঠেছে-- আলোর চাইতে আঁধার এখানে ঢের ভালো লাগে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন