হেগেলরে কি লোকজন আইজও পড়েন - ধর্ম আর ক্রিস্টিয়ান ট্রিনিটি লগে আছে কলোনিয়ালিটি
এটা একটা মুল্যবান প্রশ্ন। আমরা পড়ি । আমাদের পড়াতে হেগেলর মত মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু, পয়েন্ট ব্ল্যাক কেউ না পড়বার চাইলে আমাদের যায় আসে। (আমি জাহিদ ফারাবিয়ান মানুষ, তাই বলে, আমি কি কান্ট বা দেকারতে পড়ব না? আমি ক্রিটিক্যাল স্কুলটাকে জায়নবাদের সাথে মিলাই ফালাই। তাই বলে, হারবারট মারকুজ আর আর্নল্ড কী আমি পড়বনা! হাফি’জ হইবার মাঝে দৈন্যতা আছে, বুঝলেন, আনন্দ নাই) হেগেলরে লোকে পড়েন নানান কারণে। আমরা মোটা দাগে কয়েকটা নিয়া কথা কইবার পারি।
হেগেল খ্রীষ্টানিটির যে ব্যাখ্যা দিয়া গেছেন তা নানা অর্থেই বেশ আগ্রহ জাগায়। খ্রিষ্টানিটি অনেক দার্শনিক, অনেক ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিক তার ফলাফল হিসাবে পশ্চিমের অনেক তত্ত্বের জন্ম হইছে। খ্রীষ্টানিটির ভেতরকার যে সমস্যা-সংকট ও খ্রীষ্টানিটির বিচারের মধ্য থেকে যেসব ভাবের জন্ম, সেগুলোকে সেকুলার চিন্তার ফল হিসেবে ইউনিভার্সাল রূপে হাজির করা হয় প্রায়শই, এবং এই কাজটা হেগেল সাবে খুব ভালা করি করছেন। হেগেল সাবরে পড়ার এইডা অন্যতম একটা কারণ। লন, একটু ব্যাখ্যায় আসি।
হেগেলের মতে, স্বাধীনতার ধারণা পূর্ণতা পাইছে খ্রিস্টানিটির ভেতরে। মানুষ যে পাপ করেছে, এটা তার স্বাধীনতার স্মারক। সে পাপ করেছে এটা প্রমাণ করে সে স্বাধীন। আবার, পাপ না করার ব্যাপারেও সে স্বাধীন। সে ইচ্ছে করলে ঈশ্বরকে মানতে পারে আবার নাও মানতে পারে। সুতরাং, স্বাধীনতা মানুষের অন্তর্গত স্বভাব। গড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে দু'টো জিনিস লাভ করলোঃ একটা হলো স্বাধীনতা, আরেকটা পাইলো, যুক্তি। যুক্তিপ্রয়োগ মানুষের স্বাধীনতার চূড়ামনি।
আবার, মানুষের স্বর্গচ্যুতি ও খোদা থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া,হেগেলের মতে, একটি প্রতীকী ব্যাপার। কিসের প্রতীক?" Divide between Individuality and universal reason" এর প্রতীক। গড থেকে আলাদা হয়েই মানুষ ব্যক্তি হয়ে উঠলো। মানুষ যদি আদিতে পাপ করেও থাকে খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরো অধঃপতিত হয়, তাহলে মানুষের ‘মুক্তি’র উপায় কি? কিন্তু প্রশ্ন হলো, এক মানুষ তো আরেক মানুষকে মুক্তি দিবার পারবে না। কারণ, প্রতিটি মানুষই সত্তাগতভাবে আদি পাপের অংশীদার৷ তাই, এক মানুষ আরেক মানুষের মুক্তিদাতা হতে পারবে না। কিন্তু যদি এমন কেউ হয় যিনি একই সাথে মানুষের রূপপ্রাপ্ত ও একই সাথে খোদায়ী সত্তার অংশীদার, সে কিন্তু মুক্তিদাতার ভুমিকা পালন করতে পারবে। কারণ, মানুষের পাপীসত্তা আর তার থাকছেনা। আর যেহেতু মুক্তির কারণ হইতে হইবে মানুষের লাগি, তাই মুক্তিদাতাকে একই সাথে মানুষও হতে হবে। তো, এইভাবে "জিসাস"-এর ধারণার ভেতরে মানুষীরূপসম্পন্ন হওয়া ও খোদার পুত্র হওয়া ছাড়া খ্রীষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের সংকট মোচন হতো না। জিসাস তাঁর আত্মহুতির মধ্য দিয়ে মানবসত্তাকে পাপমুক্ত করেন। আর জিসাসের এই আত্মহুতিকে Universal Concept of Freedom এর উদাহরণ মানছেন হেগেল। হেগেল খ্রীষ্টানিটির একটা রেশনালিস্ট ভার্সন এভাবে হাজির করেন। খ্রীষ্টিয় ধর্মতত্ত্বকে তিনি দর্শনের অধীন করেন, এবং খ্রীষ্টিয় নীতিমালাগুলারে চিন্তার ডিটারমিন্ট হিসেবে উপস্থাপন করেন, যেটা দর্শনের অন্যতম কাজ। হেগেলের মতে, রিজনই হইবার পারে ইউনিভার্সাল হইতে। তো, গড হইলো উনার এবসোলিউট রিজন। আর, রাষ্ট্র হইলো Reason Personified" সুতরাং ইনার কাছে রাষ্ট্রের উদ্ভবের শিকড়টা ধর্মের মাঝেই। অবজেকটিভ রিজনের চূড়ান্ত রূপই রাষ্ট্র। আনুগত্যের প্রশ্ন ছাড়া ধর্ম ও রাষ্ট্র কোনটাই হয়না। এরিস্টটলের অনুসরণে হেগেল কইতেছেন, ব্যক্তি তার পূর্ণবিকাশ ঘটাইবার পারে একমাত্র রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন হলেই। আহেন ডায়ালেকটিক পদ্ধতি দিয়া কি দেখাইলেনঃ
থিসিসঃ মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে আইনহীন প্রাকৃতিক অবস্থা
এন্টিথিসিসঃ হায়ারার্কিকাল স্টেটে অতিনিয়ন্ত্রিত অগণতান্ত্রিক ও জাতিরাষ্ট্রে (সিনথেসিস)।
সিনথেসিসঃ গণতান্ত্রিক ও জাতিরাষ্ট্রে
যদিও, হেগেলের কাছে জাতি রাষ্ট্রই ইতিহাসের সমাপ্তি নয়।পরমের পরিকল্পনা নানাভাবেই ইতিহাসে পরিদৃষ্ট হয়। এথেন্সবাসীর কাছে এথেন্সের দুটো অর্থ ছিলঃ এথেন্স রাষ্ট্র হলো, এর প্রতিষ্ঠানসমূহের সমষ্টি, আর এক অর্থ হলো, দেবী এথেনীয় জনগণের জাতি হওয়ার প্রতীক। এভাবে, এথেন্সের রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে প্যাগানিজমের ভূমিকা ছিল। হেগেলের মতে, রাজার আয়নায়, রাজার চেহারা দেখা যায় না, দেখা যায় প্রজার চেহারা। প্রজারা যেমন হয়, রাষ্ট্র ও রাজারা তেমনই হয়। হেগেল কিন্তু ব্লু ব্লাডের কথা মানতেন। তিনি নিজ আছিলেন জার্মানজাত্যাভিমানী ও অরিয়েন্টালিস্টও। যদি আমরা এডওয়ার্ড সাইদরে মনে করি। গ্রীক ও রোমে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণী ছিল স্বাধীন। ইতিহাস পরিক্রমায় একমাত্র খ্রীষ্টানিটির আগমনের ফলেই এই অন্তর্দৃষ্টি জন্মে যে, মানুষ তার মানবসত্তার কারণেই স্বাধীন। ভাবের বা চৈতন্যের স্বাধীনতাই, হেগেলের মতে, মানবসত্তারে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলে।
মানবজাতি ও খোদার মাঝখানে জিসাস খ্রীষ্টের অবস্থান নির্ধারিত করায় তত্ত্বীয়ভাবে ক্যাথলিক খ্রীষ্টানিটিতে পাপাসি বা পোপতন্ত্রের জন্ম হইছিলো। পোপদেরকে জিসাস ক্রাইস্টের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার মনে করা হয় ৷ সুতরাং, অনুসারীদের আধ্যাত্মিক দেখভালের দায়িত্ব পোপ আর সেইন্টদের। এই পোপতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ডক্ট্রিন হচ্ছে, "মধ্যস্থতা" বা ইন্টারমিডিয়ারির ধারণা। এই ডক্ট্রিন অনুসারে, ক্ষমালাভের জন্যে যাজকের দ্বারস্থ হইতে হইবে। ব্যক্তি যাজকের মধ্যস্ততা ছাড়া সরাসরি খোদার কাছ থেকে ক্ষমা লাভের যোগ্য হয়না।
পোপতন্ত্রের আরেকটা দিক হচ্ছে, ইন্ডালজেন্সের (Indulgence)-এর প্রসঙ্গ। অর্থাৎ, কেউ কোন পাপ করে ফেললে সেটির শাস্তি কমানোর ব্যবস্থা। এইটার নানা অপব্যবহার হয়েছে খ্রীস্টধর্মে। Pardoner বলে এক অফিসিয়াল থাকত যে চার্চের ক্ষমা বিক্রি করতো। মানে, চার্চ এমন হয়ে উঠেছিল যে, তারা বেহেস্তের টিকিট বিক্রিও শুরু করে। টাকার বিনিময়ে পাপের ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হতো। সে অর্থগুলো চার্চ তার প্রভাব ও যাজকগণ নিজেদের ভোগ-বিলাসে ব্যয় করতো। হাল আমলের আমাদের দেশে আখিঁ মুন্জিয়া দ্যাখেন – যা চা্ইবেন সবি দ্যাখতে পাবেন বটে!
পোপতন্ত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে, বাইবেলের প্রাথমিকতা ও অগ্রাধিকারের পরিবর্তে চার্চ বা পোপের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হতো। যেটাকে Papal Authority বলে। পোপতন্ত্রে, পোপ বা যাজকদের বা চার্চের অভ্রান্ততা (Infallibility)-তে বিশ্বাস করতে বলা হয়। পোপতন্ত্রে ব্যাখ্যা অনেকটাই নির্বিচার ও যাজকশ্রেণীর স্বার্থলগ্ন হতো।
কইয়া রাখি অবশ্য, মার্টিন লুথারের যে রিফরমেশন বা সংস্কার আন্দোলন তা ক্যাথলিক চার্চের উপরোক্ত সংকট থেকে জন্ম। প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন নামেও আমরা পড়ি। লুথারের "ডক্ট্রিন অব টু কিংডম" ব'লে একটি ধারণা আছে; যেখানে তিনি কিংডম অব ল এবং কিংডম অব গ্রেস অথবা বলা যায়, ল এবং গোসপেল-এর পার্থক্য করেন। যেটাকে সম্প্রসারিত করে চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ ব'লে অভিহিত করা হয়। হেগেল তার "এইচ-পি’র "The German World" চ্যাপ্টারে খ্রীস্টীয় জগতকে তিন পর্যায়ে ভাগ করেন, Kingdom of Father, Kingdom of Son, Kingdom of Spirit। হেগেল মনে করতেন, সংস্কার আন্দোলনের ফলে জার্মান প্রবেশ করেছে কিংডম অব স্পিরিটে। যে জগতে চিন্তা পায় তার নিজের জীবন ও সংস্কৃতি, যেখানে রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি হইবে র্যাশনাল প্রিন্সিপল। হেগেল রাজনৈতিক আলোকায়ন, মানবমুক্তি, যুক্তি ইত্যাদি বিষয়কে খ্রীষ্টানিটির কনসেপ্টের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবেন। অবশ্য পরবর্তীতে কার্ল মার্ক্স হেগেলকে উল্টিয়ে "পায়ের উপর" দাঁড় করানোর কথা বলবেন।
তো, এইভাবে পশ্চিমা সভ্যতার অনেক ধ্যান-ধারণার উৎস খ্রীষ্টান ধর্মের (বিশেষত,সেইন্ট পলের খ্রিস্টানিটি) দার্শনিক বিচার, নানা বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা ও সংস্কার আন্দোলন। পচ্ছিমের যেসব ধারণা বিশ্বময় প্রচার পেয়েছে ও ফেরি করা হচ্ছে তার আদি উৎস রেনেসাঁস, রিফরমেশন, এনলাইটেনমেন্ট-এর দর্শন, তাদের মানুষ সম্পর্কিত ধারণা, পশ্চিমে সংঘঠিত নানা বিদ্রোহ-যুদ্ধ, এবং পশ্চিমের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে নিহিত। জাস্ট, খসড়া আকারে কিছু চিন্তা এখানে টুকে রাখলাম। স্বাধীনতা, যুক্তি, সমতা, মানবিক মর্যাদা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, জাগতিকতা ইত্যাদি নানা গালভরা শব্দ ও ধারণার ইতিহাস আছে, যে ধারণাগুলোকে পশ্চিম সবার জন্যে পালনীয় বুদ্ধির বা চিন্তার নির্ণয় হিসেবে উপস্থাপন করে । এইসব নানা ধারণার ইতিহাস নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।
জাহিদ সিরাজ