এই ব্লগটি সন্ধান করুন

সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০২২

ঘসেটি বেগমের একদিন

ঘসেটি বেগমের একদিন
সকালের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল কাকের কর্কশ ধ্বনিতে। ঘুমটা এমনিতেই ভালো হয়নি। নানাবিধ ধান্দায়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অর্ধশতাধিক মিসডকল দেখে আপাতঃত পুলকিত হল। না অন্যকারো ফোন নয়। অধিকাংশ ফোন এসেছে স্বামী নামক নিরীহ জন্তুটার। তাকে অবহেলা করে এক ধরনের আনন্দ লাভ করে ঘসেটি বেগম। প্রায় দুশো মাইল দূরে বসে বউকে ফোন করাই যেন তার কাজ। কখনো ফোন ধরে;কখনো ফোন ধরে না।আবার কলব্যাকও করারও প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করেনা। তাই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে শাওয়ার নিতে চলে গেল। শাওয়ারের এই সময়টা ঘসেটি বেগমের প্রিয় সময়। এই সময়ে সে সারাদিনের পরিকল্পনা করে যাবতীয় কুকর্মের। দপ্তরে বসে কার কার কক্ষে যেতে হবে, কার সাথে সময় কাটাতে হবে এমনি কতো কিছুর রসায়ন মিলাতে হয় তাকে। টিকে থাকতে হবে; টিকে থাকার যোগ্যতা প্রমাণ করতে তাকে এ দরজা হতে ও দরজা কিংবা বিমল মিত্রের কড়ি কিনলাম এর নায়িকার মতো – একটি উত্তপ্ত বিছানা শীতল হতে না হতেই আরো একটি বিছানা উত্তপ্ত করতে হয়। ঘসেটি বেগমের প্রতিটি দিন তাকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় ; আবেগি হতে হয়; কথায় কথায় ছিচঁকে কাঁদুনির অভিনয় করতে হয়। ঘসেটি বেগমেরা কখনো লজ্জা পায়না ,এটা থাকতে হয় । যা তার নাই। কারণ টিকে থাকাই তার নিকট চরম সার্থকতা। শ্রমিক হিসেবে নিজের শ্রম ও শরীর বিকাতে পারলে, জগতে টিকে থাকা যায়। ঘসেটি বেগম মনে মনে কবিতাটি আওড়াতে আওড়াতে শাওয়ার নিতে নিতে সে তার প্রিয় কবিতাটি উচ্চারণ করতে লাগল –
মেয়েটি নেহায়েৎ বোকা
বলনে, চলনে কিংবা মননে
তবুও খাপ খাওয়ানোর কি-না
প্রানান্তকর প্রচেষ্টা।
সফল তো হয়নি বরং
তার বেড়েছে দুর্দশা।
হঠাৎ একদিন –
সে পত্রিকায় দেখল
কর্পোরেট সংস্থার কিংবা বাণিজ্যের সংবাদ শিরোনাম।
অতঃপর বই, পত্রিকা, জার্নাল আর
অন্তর্জালে খুঁজে বেড়াল শব্দের অর্থ
অর্থের ভিতরের অর্থ-সে খুঁজতে লাগলো
যেদিন সে মর্মভেদ উদ্ধার করল- ”কর্পোরেট”
স্বাধীন সত্ত্বা শরীর টাকা কামানোর যন্ত্রও বটে—-।
এরপর থেকে চলনে, বলনে কিংবা মননে মেয়েটি কর্পোরেট জগতের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো ।।
মেহেরুন্নিসা- ঘসেটি বেগমের কেতাবী নাম। সিরাজ দৌলার খালা কিংবা মেহেরুন্নিসা- কোনটাই ততোটা জনপ্রিয় নয় যতোটা জনপ্রিয় ঘসেটি বেগম- এই নামটা। গল্পের নায়িকা ঘসেটি বেগম এর নিজস্ব নাম রয়েছে যার সার্থকতা ঠিক এরকম যেমন কালো মেয়ের নাম সোনালী। ঘসেটি বেগম এমনি একটি নাম যেন নদীর চাইতে কূল উঁচু- তাই কেতাবী নামে নয় বরং চলতি পথে দেওয়া নামেই পরিচিত হোক ঘসেটি বেগম। ঘসেটি বেগম চাকুরী কররে বরৈ সে নিজেকে পরিচিত করতে দু-চারজন একত্র হলেই বলে উঠে ”আমরা যারা গবেষক”। আহা! কি শান্তি? গবেষকও বটে , কপালে কত কি যে জোটে? সকালে বাসা থেকে বেরিয় পড়ল ঘসেটি বেগম। অফিসে ফ্রি নাস্তা খাওয়ার সুযোগ আছে বলে সে না খেয়েই চলে আসল। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল না তেমন আজ দেরী হয়নি। মনে মনে একটু বলে উঠার সাথে মনে করত গিয়ে তা করতে পারলোনা , সে কখনো সময়মতো অফিসে এসেছে । পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ডঃ আরাফাদের সাথে কুটচালের পরিকল্পনা ফাইনাল করতে হবে। রুম হতে বের হয়ে ডঃ আরাফাতের চামচার সাথে দেখা হলো করিডোরে। ঘসেটি বেগম- চামচার দিকে এগিয়ে বলল- ষড়যন্ত্রের অংশে অংশগ্রহণ করবেন না। চামচার মনে ছিল তাই বলে উঠল- ঐ দিকেই যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে ঘসেটি বেগমের মনে একটু গোপন ইচ্ছা জেগে উঠল। চামচার জিপারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল- বিয়েটা আর করা হলোনা? দুধের স্বাদ ঘোলে তো মিটাতে পারেন? কিছুই তো দেখতে পারছিনা ; বলে অভ্যাস মতো–হে !হে! হে! করে ঘসেটি বেগম- তার উচুঁ ময়লা দাঁত বের করে হেসে উঠলো। করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হলো- আরো কয়েকজনের। সবাই মিলে বসে পড়ল রুমে। রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই বলে উঠল- আরাফাদ ভাই – নাস্তা কই? হেব্বি নাস্তার ব্রবস্থা করেন। তারপর হে! হে! করে উঠল। পাতলা ওজনদার ঘসেটি বেগম। আলোচনা করতে করতে বেলা বারোটা বেজে গেল। নোংরামি আর কুটনামি আদ্যোপান্তর যেন পোস্টমটেম চলল বেলা বারোটা পর্যন্ত। আমরা যারা গবেষক – যারা আমাদেরকে গরু খোঁজার দলে মনে করেন তারা এসে দেখুক কিংবা বুঝুক আমরা কতোটা সুক্ষ্ম বা নিখুঁত ভাবে দল-উপদলে , স্বার্থোদ্ধার করতে পারি। ঘসেটি বেগম মনে মনে পুলকিত হলো এটা ভেবে যে, অনেকদিন পর বসা হলো। মাঝে মাঝে এমনভাবে বসলে কেমন হয়- ঘসেটি বেগমের এমন প্রস্তাবে সবাই সম্মত হলো। এ সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠল- চেয়ার হতে উঠতে গিয়ে বুকের আঁচলটা সরে গেল। ঝুলন্ত আর অন্তঃসারশূন্য যুগল যেন অসাড় হয়ে পড়ে আছে। কেউ আর এদিকে ফিরে তাকালো না বলে ঘসেটি বেগম মনে মনে ক্ষোভ ফেটে পড়ল। অথচ আজকের সভায় উপস্থিত তোরা সকলেই কতটাই না আগ্রহভরে দেখছিস আমার যৌবন, নদীর দুকুল যখন ছাপিয়ে উঠতঃ ঢেউয়ের তরঙ্গে তরঙ্গায়িত হলে দোলায়িত হতো তোদের মন। এই তরঙ্গের ঢেউয়ের নাচে কত সুযোগ –সুবিধা বাগিয়ে নিলাম। একটুখানি ইচ্চাকৃত তোদের ছোঁয়া- যেন অনিচ্চাকৃত এমনভাব করতি তোরা। সবই বুঝে না বুঝার ভান করে স্বার্থের জলে শরীর আর মন অঞ্জলি দিয়ে বসে বসে লাভের হিসাব করতাম। কাদের মোল্লা আলতো ছুয়ে দিয়ে বলে উঠল- ফোনটা ধরো। ঘসেটি বেগম সম্বিৎ ফিরে পেল। ঘসেটি বেগম নাম্বার দেখে অনেকটা অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ আজ সে আবার ফোন করে বসল কেন? দাদা আমার – নাতনির মাথায় হাত বুলাতো, আলতো করে ছুয়েঁ দিত আমার চুলের গোড়া – যেন হৃদয় পরশ বুলায়ে দেয়। পাঠক , এ দাদা , আমার রক্তিয় সম্পর্কের নয়। আমার অফিসের এক সহকর্মী। ছোওয়া–ছুয়িঁর খেলায় দাদা- নাতনীর সম্পর্ক আমাদেরকে যেন আগলে রেখেছিল অককেটা অক্টোপাসের মতো। দাদার কি শীতল মায়ার পরশ ; ভুল কি যায় ? আহা! কি শান্তি? মাঝখানে কোথায় হয়ে যেন কি হয়ে গেল। আমি এ গ্রুপে আর ওই গ্রুপে দাদা। সময়ের ব্যবধানে আমরা আজ কোথায়। তবুও মনে পড়ে দাদার কথা , দাদার ফোন যেন বেগমকে ক্ষনিকের জন্য উতাল পাথাল করে দিল—
 হ্যালো ! তুমি কি ব্যস্ত?
 না। মিটিংয়ে ছিলাম। বের হয়ে আসলাম।
 দুপুরের খাবারটা কি এক সাথে খাওয়া যায়?
 হ্যাঁ যায়। তাহলে কে এফসি তে বসি।
দাদার ফোন পেয়ে বেগমের মন যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। ফোন রাখতেই না রাখতেই দপ্তরের এক্সচেন্জ থেকে জরুরী সভার কথা বলা হলো। চলমান সভায় বেকুবের মতো প্রশ্ন করে বসল ঘসেটি বেগম। উপস্থিত সভ্যগন এ দিক – ও দিক তাকাচ্ছে। এটা কি করল ? সভা প্রধান যখন তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করলো তখন ঘসেটি বেগমের চোখে মুখে জল – যা তার নির্লজ্জতাকে ধুয়েঁ দিচ্ছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। দাদাও তাকাচ্ছে এদিকে। সভা প্রধান বলে যাচ্ছে। সীতার মতো এতোটা সতী নই যে ধরনী দ্বিধা হও বলে ঢুকে যাব। ইচ্ছে করছে দাদার বুকে আছড়ে পড়ি। নির্গত অশ্রু মুছে দিক , দাদা আমার। সারা বেলাটা কিভাবে গেল ? এমন সময় সময় মোবাইলে এসএমএস পেল চামচার – তোমাকে প্রকল্পের টাকায় সৌদি আরবে মাস্টার্স করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। পরক্ষনেই হে! হে! । এসএমএস করল দাদাকে রাতের ডিনারটা কেএফসিতেই সেরে ফেলি?
সভাটি শেষ হলো কাটায় কাটায় পাঁচটায়। শীতের বিকাল,সূর্য অস্ত প্রায়। যে যার মতো করে পৌঁছার সিদ্ধান্ত হলো। ঘসেটি বেগম ভাবছে দিনটা খুব একটা খারাপ কাটেনি। সুখানুভূতিটুকু নিয়ে ঢুকে দেখে দাদা আলো আধাঁরির কোনে এক টেবিলে বসে আছে। দাদা জানত তাই ঘসেটি বেগমের পছন্দ অনুযায়ী এক গাদা খাবার আগভাগেই অর্ডার দিয়েছিল । ঘসেটি বেগম খাচ্ছে আর দাদা দেখছে। এমন সময় দাদা ঘসেটি বেগমকে বলছে – সফিস্টিকেটেড প্রস্টিটিউট কি কখনো দেখেছ? না বলতেই, দাদা আমার যা বলে উঠল – তাতেই আমার ঘুম ভাঙ্গল কাকের কর্কশ ধ্বনিতে। দাদা বলল – আমার পাশেই বসে আছে একজন।
(কৈফিয়ৎ: এটি একটি কাল্পনিক গল্প)

কোন মন্তব্য নেই: