চুইংগাম
সে থমকে দাঁড়াল। “মুর্খের ভার ধরনী নিতে চায়না“- শব্দটি তার কানে বাজল হাজার ডেসিবল শব্দের ন্যায়। তবুও ডক্টরেটকে যেতে হচ্ছে। কারণ সে পড়েছে বারবার। এটা দোষের নয়। কেউ একবার পড়ে, কেউ বার বার পড়ে। বার বার পড়াটা অবশ্যই শালীনতার পর্যায়ে আর থাকে না। আর আরাফাদ সাহেবের বেলায় তো নয়ই। তবুও সে পড়েছে কিংবা পড়ে আছে এখনো। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। বিষয়টির একটা পোষাকী নামকরন দরকার। পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা এর নামকরন করেছে চুইংগাম কেস হিসেবে। যতক্ষণ মজা, ততক্ষণ মুখে। বিষয়টি আরাফাদ সাহেবও জানেন এবং সর্বান্তঃকরনে মেনে চলেন। যার কারণে চুইংগাম কেসটি এখন লোকপ্রিয় বিষয়। একদিন আরাফাদ সাহেব এর অফিস থেকে দুই সহকর্মী বাসায় আসলে, পুরাতন সহকর্মীটি রাস্তার পাশের দোকানে আড্ডারত ছেলেদের- বাসাটি কোথায় জানতে চাইলে, চা এ চুমুক দিতে দিতে এক রকম না তাকিয়ে লম্বা ছেলেটি, যাকে দল নেতা মনে হয়েছিল সে ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিয়েছিল- চুইংগাম আরাফাদকে খুঁজতাছেন? সোজা উত্তরে গিয়ে সাত তলা ভবনের দুই তলার ডানের ফ্লাটে থাকেন-চুইংগাম সাহেব। প্রথমে বুঝতে না পেরে সদ্য বদলী হয়ে আসা সহকার্মীটি বলল- না, না আরাফাদ সাহেব চুইংগাম কেন? লম্বু ছেলেটির তাচ্ছিলে্ তাকানোয় সহকর্মীটি অপর সহকর্মীটির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে- ঠিক আছে ভাই, বুঝতে পেরেছি। সাথে থাকা পুরাতন সহকর্মীটির মুখে সব শুনে সাথে থাকা নতুন সহকর্মীটি যেন লজ্জা পেল, যেটা মানুষের থাকতে হয়।
ডক্টর আরাফাদ সরকারী চাকুরী করে, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়, যদিও কর্মক্ষেত্রে নামের পূর্বে এই ড. লেখাটি কোন বাস্তবিক অর্থে কোন কাজে লাগেনি তার, তবে তাকে এ জন্য আড়ালে ক্রিমিনোলজীর অধ্যাপক বলে সহকর্মীরা খ্যাতি ছড়ায়। আরাফাদ সাহেব বিষয়টি বুঝে একে ওকে গালাগালি করে, যেটা তার অত্যন্ত প্রিয় কাজ, অবশ্য এ প্রিয় কাজটা সে আড়ালে আবডালে করে থাকে। সামনা সামনি বলার সাহস রাখেনা, এরা বরাবরই দুর্বল হয়। চুইংগামের বিষয়টিও এরকমভাবে সে জড়িয়ে ফেলেছে, উট পাখির মতো ধুলার ঝড়ে মাথা লুকাতে গিয়ে ড. আরাফাদ নিজের চরিত্রটাকেই জন সম্মুখে প্রকাশ করে ফেলেছে। বিষয়টি এখন এমন যে তার মাথার চুল হতে পায়ের নখ পর্যন্ত আঠাময়। এরপরেও তাকে দেখে অনেকে পারস্পরিক কথাবার্তায় ফিসফিস করে বলে- লজ্জা তো দেওয়া যায় না, এটা থাকতে নয়। আরাফাদ সাহেব বিষয়টা বুঝেও না বুঝার ভান করে। যে যাই বলুক, চুইংগামের প্রতি তার আকর্ষণ, দুর্নিবার। তাই তিনি বার বার এ মজায় মজেছেন এবং আপাতঃত দৃষ্টিতে মনে হয়- তিনি আমৃত্য পর্যন্ত চুইংগামে মজে থাকতে চান। কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারেন না যে, এটা প্রথম প্রথম স্বাদ লাগলেও পরে বিস্বাদময় হয়ে উঠে, মুখ থেকে ভুলে শরীরে কিংবা চুলে লাগলে এটা কতো জটিল হয়ে যেতে পারে। এরকম ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কন্যাসম এক জুনিয়র কলিগের সংগে সর্ম্পক জড়িয়ে। কন্যাটি চতুরতার সাথে সম্পর্কটিকে থেকে প্রগাঢ়ময় করেছে। ফলে প্রেমময় দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে কন্যাটির। যদিও কন্যাটি পারিবারিক সম্মতিতে কৃষ্ণলীলা সাঙ্গ করে বিধিবন্ধ জীবনে আবন্ধ হয়েছিল। কিন্তু বন্ধনটি আলগা হতে তার বেশী সময় লাগেনি। কন্যাটি, ডক্টরেটকে উপরে উঠার সিড়িঁ হিসাবে ব্যবহার করতে গিয়ে কখন যে তার সময় কাটানোর পাটাতন হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে বুঝতেই পারেনি। ডক্টরেট তাকে চেয়েছিল ডাইরেক্ট হিসেবে। কন্যাটিও তাই। ফলাফল হিসেবে কন্যাটি হারালো তার গোছালো সংসার। পঞ্চাশোর্ধ ডক্টরেট আর অনধিক ত্রিশের কন্যাটি এবার বেপরোয়া হয়ে উঠল। তিন সন্তানের জনক, তার সন্তানের জননীতে ডক্টরেট খুশী নয়, সে সুখ খোঁজে এথা নয় হেথা, অন্যকোথা। এভাবেই সুখের সন্ধানে সে আড়াই দশক ধরে তার মাস্তুল ফেলে এ ঘাটে সে ঘাটে। ঘাটান্তরে আরাফাদ সাহেবের ভাবান্তর ঘটেনা। কিন্তু মনান্তর ঘটে সহকর্মীদের। তবু তারা দমে যায় না। আড়ালে নয় বরং স্বঘোষিত হয়ে তারা প্রকাশ্যে আসে জনতার মঞ্চে। নিজের মতো করেই চলতে চায়। ভালোবাসার সীমা আর পরিসীমার ব্যবধানটুকুও তারা মানতে চায়না। তাই, দুজনের কলঙ্কময় অতীত অধ্যায় এখন সকল সহকর্মীর মুখে মুখে। ধীরে ধীরে এটা তার গন্ডি পেরিয়ে এখন তার পাড়ার গলিতে। কেবল কথা উড়ছে। আর ডক্টরেট সাহেব ভাসছে সাথে নিয়ে তার কলঙ্কিনী রাধাদের। মাঝে মাঝে দ্যুতক্রীড়ার বর্ণনা যে পাওয়া যায়না, তেমন নয়। বরং সে সকল বাৎসায়নের কামসূত্রকেও হার মানায় সে বর্ণনা।
কন্যাটি শঙ্কিত এবং আতঙ্কিত এ সম্পর্কের পরিণতি কি হবে তা নিয়ে? কন্যাটি জানতে চায় টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে। ডক্টরেট, শান্ত কিছু বলে না। কন্যাটির গলা ধরে আসে, হ্যাঁলো, তুমি কি শুনতে পাওনা? ডক্টরেট পৌষের শীতেও ঘামছেন, শুনছি বলে উত্তর দেয় আর ঘাম মুছতে গিয়ে বাম হাতে লুঙ্গি উপরে তুলে ফেলে। ভাগ্যিস মধ্য রজনী। কেউ দেখেনি। কন্যাটি অহিসাবী রাতের তার হিংস্রতা কিংবা উম্মতার নিখুঁত বিবরনী তুলে ধরে, ফসল ঘরে তোলার সময় যে হয়েছে, তা বার বার মনে করিয়ে দেয়। ডক্টরেট এবার বুঝি গেল – অস্কুট স্বরে বলে উঠল আরাফাদ সাহেব। সব পাপের শেষ আছে। সে কন্যাটিকে বলতে চায়- কিভাবে হলো এটা। আমি তো বরাবরই প্রটেকশন নিয়েছিলাম। উত্তর শুনে কন্যাটি আতঙ্কগ্রস্থ হয়। ডক্টরেট, তুমি কি বলতে চাও? আমাকে সন্দেহ কর? তোমার জন্য চুরি করতে গিয়ে, আমাকেই শেষ পর্যন্ত চোর বানালে? কন্যাটি কাঁদে, সেল ফোনের এ প্রান্তে, ডক্টরেট ও প্রান্তে এর পরও শান্ত সে। সদুপদেশ দেয়- একে ফেলে দাও। কন্যাটি যতবার না বলে, ডক্টরেট ততবার হ্যাঁ বলে। সিদ্ধান্ত আর আসে না। অবশেষে কন্যাটি দ্বিধা-দ্বন্দ ফেলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। নিজেকে হত্যা করে। চিরকুটে লিখে যায়- স্বীকৃতি না পাওয়ায়, যার কারণে জগতের আলো যে দেখতে পেলনা, সেই ডক্টরেট যেন শাস্তি পায়।
অফিসে পুলিশ। লাশ মর্গে। সহকর্মীগণের কানাকানি। কোটায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। মন্ত্রী বা দালালীর ফলস্বরুপ সুপারিশে চাকুরী। ফপরদালালী করে অফিসের টাকায় ডিগ্রী । অযথা আত্মঅহংকারী। আলুর দোষে বহুবার দোষী। যেন আহাম্মক? কেউ কিছু বলে না। এর অর্থ এই নয় যে, কেউ কিছু জানে না, বরং লজ্জা আর ঘৃণায় এড়িয়ে চলে। পুলিশ ডক্টরেটকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন সম সে পিছন হতে শুনতে পেল- “মূর্খের দাপট, ধরনী ভার নিতে চায়না”। কে বলল পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে ডক্টরেট থমকে দাঁড়াতেই বেয়াড়া পুলিশটি বলে উঠল- “চল স্টুপিড”।
( বিঃ দ্রঃ সকল চরিত্র কাল্পনিক, সাদৃশ্য অনিভেপ্রত ও কাকতালীয় মাত্র )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন