পূবোর্ক্ত শিরোনামের শুরুতেই প্রশ্ন ছিল -নারীর মূল্য কোথায়? প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরতের এ প্রশ্নে উত্তর আমরা পাই হুমায়ুন আজাদের (২০০০) লেখায়। তার পূর্বে একটি কামাতুর শরীরের পৌরাণিক গল্পের নায়িকার প্রাসজ্গিক অবতারনা। একটি নারী। পাঁচ সন্তানের জননী। একটি প্রজনন অঙ্গের মালিক; যদিও প্রকৃত মালিক তার স্বামী জমদগ্নি। রেনুকা একটি শরীরও বটে। যে শরীরে আছে জীবন ও যৌবন কিন্তু এ দুয়ের মালিক তিনি নন তবে ক্ষমতা প্রয়োগ যন্ত্রের অংশ বটে। এ শরীরের একছত্র মালিক তার স্বামী কিন্তু পুনরুৎপাদন কিংবা জন্মহার নিয়ন্ত্রণ হবে নারীর শরীরের মাধ্যমেই, নিয়ন্ত্রক স্বামী। তাইতো পাঁচ পুত্র সন্তানের পরিশ্রমী রেনুকা যখন নদীতে স্নান করতে যান। তখন দেখতে পান যে, তার দেশের রাজা নদীর আরেক পাশে তার রানীদের সঙ্গে জল কেলী খেলছে। রাজা-রানীদের এই জল কেলীতে স্বভাবতঃই রেনুকা নিজেই কামাতুর হয়ে পড়েন, যা আমার-আপনার জন্যও প্রযোজ্য কারন-“চোখের দাবি মিটলে পরে তখন খোঁজে মন, তাই তো প্রভু সবার আগে রূপের—” (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত/ মদনমহোৎসব)। জীবন ও যৌবন ভরে উঠে রসে। শরীর সিক্ত হয়ে যায়। বিশেষ অঙ্গ ভিজতে থাকে। যাকে রাধার ভাষায় বলা হয়- অঙ্গের জ্বলুনি। রেনুকা কিন্তু এ অঙ্গের জ্বালা তার দেশের রাজা দ্বারা নিভায় না বা মনে মনে কামনা করেও না। কিন্তু ঋষি স্বামী জমদগ্নি, তাঁর ধ্যানের ক্ষমতা বলে বুঝতে পারে যে, রেনুকার শরীর কামার্ত হয়েছিল, ভিজে গিয়েছিল শরীরের বিশেষ অঙ্গ। রেনুকা তার যৌন শুচিতা হারিয়েছে, মনের অজান্তেই জড়িয়েছে পরকীয়ায়। হায়রে! পুরুষ রাজাটি জানতেই পারল না যে তাকে দেখে লোভাতুর হয়েছিল অন্য কেউ। অথচ পুরুষ সৃষ্টির অদ্যাবধি থেকে আজ পর্যন্ত দৃষ্টিতে আসা নারীকে পরখ করে দেখে যৌনতার চোখ দিয়ে। জড়িয়ে পড়ে কামনার পরকীয়ায়। সে জন্য কোন পুরুষের শাস্তি তো হয়নি বরং পুরুষ সেজেছে মহৎ! পরবর্তীতে পরকীয়ার মতো মহাপাপের জন্য পিতার আদেশে পরশুরাম তার নিজ মাতাকে কুড়াল দিয়ে হত্যা করেন। বাধ্য সন্তানকে পিতা পুরস্কৃত করাতে চাইলে, বুদ্ধিমান সন্তান পুনরায় মায়ের জীবন ফেরৎ চান। মহাতপস্বী ঋষি পিতা জমদগ্নি- পুনরায় যৌনশুচি মিলনের জন্য হোক বা সন্তানের মনস্কামনা পূরণার্থে হোক রেনুকাকে পুনঃজীবন দান করেন।
এ জাতীয় অন্য আরেকটি গল্পের অবতারনা করার পূর্বে এটা তো বলা যায় যে, পুরুষ নিজেকে বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে কখনোই আনেননি কিংবা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হোননি বা হতে চাননি। কারণ পুরুষ-বরাবরই যৌনতাকে উপভোগ করতে চেয়েছে নিজের মতো করে বিশুদ্ধতার মানদন্ডে আর শুচিতার একেবারেই উচ্চ মার্গীয়তায়। যার ফলে নারী পরিণত হয়েছে যোনি, যৌন বস্তু তথা কামের পরিতৃপ্তির উপকরনে। এখানে পুরুষের দ্বৈত আচরণ লক্ষ্য করার মতো যে, নিজের স্ত্রীকে শুচিতার মোড়কে ঢেকে রাখে, আবার নিজেই পরস্ত্রীকে চেখে দেখে। যেমনটা দেখি ইন্দ্রের বেলায়। ইন্দ্র, গৌতম মুনির স্ত্রী অহল্যার সাথে ছলনার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। ভোরে গৌতম মুনি আহ্নিক স্নানে গেলে, ইন্দ্র গৌতম মুনির বেশে সঙ্গম করেন। কেউ কেউ বলেন- ইন্দ্রকে অহল্যা চিনতে পেরেও সঙ্গমে সম্মত হোন। স্নান শেষে গৌতম মুনি ফিরলে বুঝতে পারেন এবং উভয়কে শাপান্ত করেন।যদিও কেউ কেউ (আহমেদ: ২০২০) একে ধর্ষণ বলেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই একে ধর্ষণ বলা যায়না। কেননা উভয়ের সম্মতিতে তা স্থাপিত হয়েছে বরং যে বিচারে আমরা রাধা কৃষ্ণের সম্পর্কের বিচার করতে বসেছি বরং এটা তাদের পূর্বপুরুষের ঘটনামাত্র। কারণ গৌতম মুনি অহল্যাকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলে “মার্জার চলে গিয়েছে।” এই মার্জার শব্দটির অর্থ “নিষিদ্ধ প্রেমিক”। কারণ ছদ্মরূপ চিনতে পেরেও তিনি সঙ্গমে সম্মত হোন।
তাহলে- শুচিতা থাকবে কোথায়? হালের ডেসটিনি কোম্পানীর গল্পের মতো- সবাই ক্রেতা আর বিক্রেতা; যেন একাকার। কিন্তু লাভের হদিশ নাই। কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রে এমনটা হলে মুশকিল নয়, মহামুশকিল হবে-আসান মিলবেনা কোথাও। যার দরুন-পুরুষ নারীকে নির্দেশ করে, নারীর স্বাতন্ত্র্য বোঝায় নিজের স্বার্থে তুলনা করে। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, নারীর যৌন অঙ্গই হচ্ছে সকল নেতিবাচক কর্মকান্ডের সূত্রপাত। নারী তার পরাজয় স্বীকার করে তার এই বিশেষ অঙ্গ বা যৌনতার কারনে অথবা পুনরৎপাদনের দরুন। তাই রাধা তার যৌনতাকে ব্যবহার করে তার স্বাধীনচেতার কর্মকথা অকপটে বলে গেলেও সমাজ-সংস্কারবাদীরা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ চাপিয়ে আমরা-কি নারীমুক্তিকে আটকিয়ে রাখিনি? আর এ সকল কারণে বলা যায় যে, নারীর কাছে পুরুষ যৌনতার বিশুদ্ধতা চায় কিন্তু নিজে? প্রশ্নটি অবান্তর। অথচ রাধা তা শুরু করেছিল অনেক আগেই, শ্বাশুড়ি, বর বা জামাই, ননদ পরিশেষে সমাজের রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে নারীমুক্তির কথা বলেছিল প্রকাশ্যেই, অকপটে। তাই রাধা গলায় সুর তোলে মাঠে ঘাটে গেয়ে উঠে-
“খুঁজে খুঁজে ফিরি সরানেরও ধারে,
কেষ্টাব্যাটা মোর, গেলো কোথায়?
এমন দিনে মোর পিরিতি লাগিল
কেষ্টো গরু চড়ায়।
ফাগুন দিনে আসি জলেতে নামিলাম
মন পড়ে থাকে পাড়ে।
বসন ফেলে রাখি, মনেতে ঢেউ লাগি
কেষ্টো, নেই কোন ধারে।
ঘরেতে ফিরিলাম, গতর খাটিয়ে
রাতের রং এ শরীরে
পিরিতির চাঁদ উঠে, বাঁশীতে সুর নাই
কেষ্টো মরে ঘুমের ঘরে।
আমি খুঁজে ফিরি, আধারে বাদারে
পিরিতির জ্বরে, জ্বলে মোর
কোথায় গেলো মোর কৃষ্ণ কালারে
কোথায় গেলো বৃন্দাবন।”
(অনন্যা খেঁদার গাওয়া গান ইউটিউব লিংক থেকে নেওয়া)
(গীতিকার পাতাল ক্ষ্যাপা)
আমরা ধরতেই পারি রাধার এমন উচ্চারণ- সাহসী কণ্ঠস্বর। পরকীয়ার প্রেমের জন্য নারী বরাবরই এর শিকার। সকল বঞ্চনা ও গঞ্জনা নারীকেই সইতে হয়। ক্ষমতার আঁধারে নারী অসহায় জীব। পুরুষ বরাবরই সুবিধা ভোগী সাহিত্যে কিংবা ব্যক্তিজীবনে-পুরুষ ব্যাখ্যা করেছে নিজেকে নিজেরেই অঙ্গ বাঁচিয়ে। ফলে নারীর বিশেষ অঙ্গ ভিজলে রসিকতা করেছে পুরুষ; নারী শিক্ষিত হলেও আজো প্রতিবাদের ভাষা ক্ষীণ, মোলায়েম। কিন্তু সময়, যুগ ও পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় রাধার প্রতিবাদ উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। রাধা কৃষ্ণের কাছে খবর পাঠানোর জন্য দূতও নিয়োগ করে করুন সুরে বলে উঠে- “মাথার বেণী খুলে দিবো, তারে আইন্যা দে।” রাধার এমন সাহসী, প্রতিবাদী, সমাজরে প্রতি ভ্রুকুটি নিক্ষেপ তথা পুরুষশাসিত সমাজরে প্রতি অভিশাপ। রাধার এমন ক্ষমতার ব্যবহারকে কেইট মিলেটের (১৯৬৯) “সেক্সুয়াল পলিটিক্স” এর দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। অথ্যাৎ যৌনতার সম্পর্ককে যে লৌকিক রাজনীতির দৃষ্টি কোণ থেকে দেখেছেন, সেখানে স্বামী, ডাকিনী শ্বাশুড়ি, ও নাগিনী ননদী থাকা সত্ত্বেও রাধা পরকীয়া প্রেমের স্বপক্ষে যে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় উচ্চারনে প্রেমিক প্রবর শ্যামের সাথে মিলনের অভিপ্রায় কি পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ? যদি যুক্তির খাতিরে মেনে নেই, রাজনীতির মূলকথা-ক্ষমতা। যা নিয়ন্ত্রণে ও ভোগে একচ্ছত্র অধিপতি-পুরুষ। তাহলে তো বলতেই হয় আজকের নারীর ক্ষমতায়নের ঝাণ্ডা উত্তোলনের যাত্রার মহারথ উদ্বোধন করেছিল রাই বিনোদিনী। যে কিনা সেই পুরুষালি ক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শনে নিজস্ব বিশেষ অঙ্গের বর্ণনা করেছেন অনায়াসে যেখানেই নিহিত রয়েছে নারীমুক্তির; গ্রোথিত আছে শুচিতা বা সতীত্বের কীট। আজকের যুগের সকল নারীবাদী তত্ত্বগুলো অন্ততঃ তাই বলে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে নারী মুক্ত ছিল; গর্ভধারন, শ্রমবিভাজন কিংবা কৃষির প্রসার নারীকে বন্দিনী করে ফেলেছে। তাই নারীর মুক্তি তব অঙ্গে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন