এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

যৌন শুচিতার অভাব পরকীয়ায়ঃ প্রশ্ন কেন?

    

নারীর মূল্য কোথায়?শরৎ চন্দ্রের এমন প্রশ্নের উত্তরে যে উত্তরটি মাথায় আসে- তা হলো নারীত্ব (শরৎ:২০০৮:৭)। এই নারীত্ব কোথায় পাওয়া যায়? যদিও শরৎ প্রশ্ন তুলেছেন- ”ইহার কোন মূল্য হয়না তাই এটা অমূল্য”। কারণ “নারীত্বের সাধারণ মূল্য ধার্য করিবে কি করিয়া” বলে পাঠকের মনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে শরৎ আপাততঃ নিরুত্তর। তবে, জল যেমন অপরিহার্য আমাদের জীবনে, তেমনি নারীর জীবনে নারীত্ব তেমন গুরুত্ব বলে তিনি মনে করেন। সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় গ্রন্থে-এই নারীত্বের জয় জয়কার এমনকি প্রকৃতির বেলায়। আমরা সবাই নারী চাই, যে নারী কেবলই আমার, সে রক্ষা করবে শুচিতা বা সতীত্ব। কিন্তু বলার ক্ষেত্রে বলছি- প্রেমের আসল মজা পরকীয়ায় বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি! ঠিক অনেকটা বিশ্বমঙ্গলের নাটকে বিধৃত কাহিনীর মতো। শরৎ চন্দ্রের ভাষায় (২০০৮:১৪) এ প্রসিদ্ধ নাটকে গৃহকর্তা নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে অতিথিকে বিমুখ করবেনা (কারণ শাস্ত্রে আছে সর্বস্ব দিয়াও অতিথিকে সংস্কার করিবে) বলে নিজের সহধর্মিনীকে লম্পট অতিথির শয্যায় প্রেরণ করে। পাছে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও অধর্মের কারণে যমদূতের হাতে মার খেতে হয়।

মহাভারতে এমন পরস্ত্রী সম্ভোগের গল্পের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। বলি রাজাও তার স্ত্রী দীর্ঘতমাকে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে অন্যের সহবাস করান। এরকম ঘটনাকে বিদ্যাতয়নিক চর্চায় বস্তুকামী বলে আখ্যা দেওয়া হয়, যারা নিজের স্ত্রীকে অন্যের সঙ্গেঁ সহবাস করতে দিয়ে আনন্দ পান; যদিও মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটা মানসিক বৈকল্য। বিদ্যায়তনিক টেক্সট এর ভাষায় এদেরকে অসৎপতি (Cuckold) বলা হয়। আয়ান ঘোষ এমন পতি ছিলো কি না তা বলা যায় না নিঃসন্দেহে। তবে রাধা যৌনতার সম্পর্ক স্থাপনে যে বিপ্লবের সূচনা করেছেন, খ্রি.পূর্ব ৪০০ বছর আগে, নারী সমাজ তা ধরে রাখতে পারিনি বলা যায় বলিষ্টভাবে মাতৃত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে নারীর যে ঐতিহাসিক পরাজয়ের সূচনা হয়, তা যৌন স্বাধীনতা বিসর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায় (বাখোফেন, এঙ্গেলস, রেবতী প্রমূখ সমাজচিন্তাবিদদের লেখাসমূহ বিবেচনা করুন)

পৌরুষত্ব এমন এক শক্তি- যা নারীও তার অন্তরে ধারন করতে পারে। যার ফলে নারী হয়ে উঠে বিদ্রোহী, শক্তির আঁধার। পুনরৎপাদনের জন্য হোক কিংবা তার পৌরুষত্ব বিকাশের তরে সে তখন শূচিতার ধার ধরেনা। যা মনে করা হয় কেবলই নারীর জন্য। উদাহরণ, এমন একাধিক নারীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। রাধা ব্যতীত কুন্তী, অহল্যা, উল্লুপী, অম্বালিকা, অম্বা, শিখন্ডী সহ আরো অনেকে।দ্রৌপদীর যৌনতা ঐ সময় ও সমাজের জন্য লাগসই হলেও উলূপীর পরস্বামী সম্ভোগে সন্তান পুনরৎপাদনকে আপনি কি বলবেন?

মহাভারতে সমসাময়িককালে উলূপীর ন্যায় অনেক নারী পাওয়া যায়। যারা সাহিত্যের মাধ্যমে ঐ সময় ও সমাজের ছবি প্রতিনিধিত্ব করে কারণ সাহিত্য সমাজের দর্পন তো বটেই। এ সকল নারীর মাধ্যমে যৌন শুচিতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়যে, এটা কেবল নারী জন্য প্রযোজ্য বিষয় ছিলোনা যদিও কালক্রমে এটা নারীর কাছেই প্রত্যাশিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেটা ফ্রেডরিক এ্যাঙ্গেলস পরিবারের নামক সংস্থার বিবর্তনের মাধ্যমে খোলাসা করেছেন তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ- পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি  নামক গ্রণ্থে

যৌনতা বলতে আমরা যাই বুঝি না কেন- পরিবার নির্মাণে বা বির্নিমানে এর ভূমিকা মুখ্য এবং শরীর কেন্দ্রিক। হয়তো এ কারণেই ফুঁকো ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের নতুন নতুন বিষয় বস্তু খুঁজে পেতে সমর্থ হয়েছেন। যেমন- যৌনতা, শাস্তি ও উন্মাদনা (সুধীর: ২০১০:১৫) ফুঁকো মনে করেন- সেক্স এক বিশেষ ডিসকোর্স, যেখানে বিবাহের ধর্মীয় বা আইনী বাধ্যবাধকাতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্ঞাতি সম্পর্ক ও সম্পত্তি হস্তান্তরের নিয়মাবলী (সুধীর: ২০১০:১৬)। কিন্তু যৌন চর্চায় এ সকল নিয়মাবলী সকল সময় মেনে চলেনি, এমনকি রাধা-কৃষ্ণের যে সম্পর্ক তাতেও এর ব্যত্যয় পাওয়া যায় মহাভারতেও বিদ্যমান অপরাপর অন্যান্য যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। প্রশ্ন হলো যৌন সম্পর্ক স্থাপন কি দাম্পত্য কিংবা পরকীয়ায় শুচিতার দায়ভার কেন এককভাবে নারীর। এটা কি ক্ষমতা চর্চার ফলাফল না কি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থারই ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া, যা আজও বহমান আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

যে প্রতিক্রিয়ায় ফুঁকো উত্থাপিত অবদমনের প্রকল্পের (রিপ্রোসিভ হাইপো বিসিস)-টের/ইঙ্গিত পাই, যার অস্তিত্ব  অনেক আগেই মহাভারতের কাজে পাই। এ প্রকল্প যৌনতাকে নানাবিধ বাধা নিষেধ, নৈতিকতার বেড়াজালে অবদমিত করে রাখে, করে বিনির্মান। ফলে, এক জটিল ধারণা বা অভ্যাসের সৃষ্টি হয় যা- নানাবিধ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, অনুসন্ধান, কথাবার্তা, লেখার মাধ্যমে প্রকাশকারি বলে একে “ডিসকোর্স” ও ডিসকার্সিভ প্র্যাক্টিস বলতে পারি। যেটি যৌনশুচিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য,তবে শুধুই তার বিষয়বস্তু হবে নারী। ফলে যৌনভাবনায়ত্ত বিবর্তন ঘটে এবং এ ভাবনার কেন্দ্রমূলে থাকে শারীরিক মিলনকে কেন্দ্র করে। এমন দেহগত মিলনের যে স্থুল চিন্তা তার অতি প্রকটরূপ আমরা ভারতীয় ঐতিহ্যে দেখতে পাই এবং প্রাচীন মহাকাব্য পুরাণ শাস্ত্রে নারী পুরুষের কাম চরিতার্থ করবার প্রবণতা বড় রকমের বাড়াবাড়িও লক্ষ্য করি (সুধীর: ২০১০;আহমেদ: ২০২০)। এ রকম  বাড়াবাড়ি আমরা কেবল নারীর শরীরের নিয়েও পাই। দেখা যেত পারে পরবর্তী উপ-শিরোনামে--।


 

কোন মন্তব্য নেই: