“ভ্রমর কইয়ো গিয়া- শ্রী কৃষ্ণের বিচ্ছেদে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া” এমন গানের তাৎপর্য বিশ্লেষণের পূর্বে গানের লিপিকার সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ রাধা-কৃষ্ণের উপস্থিতি সংবলিত ফোক বা লোকায়ত সংক্রান্ত গান ও সুরের স্বীকৃত প্রদান না করার বড়রকমের বিতর্কও দেখা যায় (চৌধুরী:২০০০;নিউটন: ২০১৫)। এ গানের গীতিকার রাধারমন দত্তের (১৮৩৩-১৯১৫) জন্ম তৎকালীন শ্রীহট্ট বা হালের সিলেটে। এ অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি 'ধর্ম ফাঁ' কর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে 'আনন্দ শাস্ত্রী' নামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন বলে গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। আনন্দ শাস্ত্রীর প্রৌপুত্র নিধিপতি শাস্ত্রীর পুত্র ভানু নারায়ন। উক্ত ভানু নারায়নের চার পুত্রের মধ্যে রামচন্দ্র নারায়নের এক পুত্র ছিলেন প্রভাকর। বলা হয়ে থাকে যে, মুঘল সেনাপতি খোয়াজ উসমান দ্বারা ইটা রাজ্য অধিকৃত হলে, এই রাজ বংশের লোকগণ পালিয়ে গিয়ে আশে পাশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় প্রভাকর দত্ত তার পিতার সাথে আলিসারকুল চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন বসবাস করার পর জগন্নাথপুর রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। কিছু দিন পর জগন্নাথপুর রাজ্যের তৎকালীন অধিপতি রাজা বিজয়সিংহের অনুমতিক্রমে প্রভাকর জগন্নাথপুরের নিকটস্থ কেশবপুর গ্রামে বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন। পরবর্তীতে রাজা বিজয় সিংহ প্রভাকরের পুত্র সম্ভুদাস দত্তকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অতপর বানিয়াচংয়ের রাজা গোবিন্দ খা বা হবিব খার সাথে বিবাদে জগন্নাথপুর রাজ বংশের বিপর্যয়ের কারণ, রাজআশ্রীত কর্মচারীরাও দৈন্য দশায় পতিত হন । এ সময় সম্ভুদাস দত্তের পুত্র রাধামাধব দত্ত অন্যের দ্বারস্থ না হয়ে, অনন্যচিত্তে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। রাধামাধব দত্ত সংস্কৃত ভাষায় জয়দেবের বিখ্যাত গ্রন্থ 'গীত গোবিন্দ' বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তার রচিত ভ্রমর গীতিকা, ভারত সাবিত্রী, সূর্যব্রত পাঁচালি, পদ্ম-পুরাণ ও কৃষ্ণলীলা গীতিকাব্য উল্লেখযোগ্য। এই প্রসিদ্ধ কবি রাধামাধব দত্তই ছিলেন রাধারমণ দত্তের পিতা।
কবি রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তার পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীতগৌবিন্দ এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা তাকেও প্রভাবিত করেছিল। ১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমণ পিতৃহারা হন এবং মা সুবর্ণা দেবীর কাছে বড় হতে থাকেন। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দ বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতার রচিত গ্রন্থ গুলো সে সময় তার জন্য পিতা আদর্শ হয়ে অন্তরে স্থান করে নেয়। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রচনা করেন অংখ্য বাউল গান । লিখেছেন কয়েকশ ধামাইল গান। জানা যায়, সাধক রাধারমণ দত্ত ও মরমি কবি হাসন রাজার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। অন্তরের মিল ছিল খুব বেশি। তাদের মধ্য বিভিন্ন সময় পত্রালাপ হতো কবিতায়।
ফিরে আসি প্রাসঙ্গিক বনমালীতে। কে এই বনমালি? সোজা সাপটায় বলা যেতে পারে যে, দাপর যুগের ত্রাতা- কৃষ্ণ। সর্বভারতীয় অঞ্চলে যখন অন্যায়-অবিচারে পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পায় তখন অযোধ্যায় দেবকী ও বাসুদেবের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন ঐযুগের অবতার-কৃষ্ণ। ছোট বেলায় ডানপিটে, দুরন্ত বালক, মামার কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঝড়ের রাতে বাসুদেব অলৌকিক ক্ষমতার লীলা খেলায় বৃন্দাবনে যশোদার ঘরে রেখে আসেন। চৌদ্দ বছর পর্যন্ত যত লীলা খেলা–এই বৃন্দাবনে। যেখানে একই সময়ে তথাকথিত ১৫ দিন পর জন্ম নেয় রাধা - প্রেম ও খেলার ঊভয়ের সাথী। এই রাধা-কৃষ্ণের রসায়ন নিয়ে যতো প্রেম-কাহিনী আর গল্পে হয়েছে সবগুলোই প্রেমের মাহাত্ম্য বা জীবাত্মার বর্ণনা করা হয়েছে। কেউ কেউ পরকীয়া প্রেমের এক নিদারুন আদর্শের উদাহরণ টেনে তুলে ধরেন। যুগে যুগে এ প্রেমের মাহাত্ম্য এতই বর্ণনা করা হয়েছে যে, এখন বলা হয় প্রেমের আসল মজা নাকি পরকীয়ায়। সমাজ ও সংস্কৃতিতে তাই এ ধরনের প্রেমের জয়-জয়কার বটে। ওই যে, ভালো লাগার নিজস্ব ধরনটুকু হতে হবে আপনার - আপনি কি করবেন- আপনার উত্তরের উপর নির্ভর করবে আপনার কর্ম ও কর্মের ফল?
এই শ্যাম-রাই, যাদের প্রেমের উপর বাংলার লোক সংস্কৃতি জগতে দু’টি বিখ্যাত গান পাওয়া যায়। সেই গান দুটোর আলোকে আজকের পরকীয়া প্রেমের শবচ্ছেদ করার একটি প্রয়াস মাত্র যা আমাকে ভালো লাগে এমন একটি প্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ মাত্র। যেমন- “বনমালি তুমি পর জনমে হইও রাধা।” আর দ্বিতীয় সঙ্গীত খানা- “ভ্রমর কইয়ো গিয়া- শ্রী কৃষ্ণের বিচ্ছেদে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া।”
“বনমালি ..............পরজনমে হইও রাধা।” আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যৌনতা সম্পর্কিত আলোচনা বাতুলতা মাত্র অথচ বাৎসায়ন এসংক্রান্ত আলোচনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ - খ্রিস্টাব্দ ২০০ সময়ে রচিত তাঁর কামসূত্র নামক বিখ্যাত গ্রণ্থে। ধর্ম, অর্থের ন্যায় যৌনতাকে তিনি সমগুরুত্ব দিয়েছেন একটি সুস্থ জাতি বিনির্মানে। এ সম্পর্কিত আলোচনা মানেই এক ধরনের সুড়সুড়ি কারণ এ রকম শিরোনাম যে লেখার বিষয়বস্তু হতে পারে তা আমাদের চিন্তা-চেতনায় আসেনা মধ্যবিত্তের দার্শনিক চিন্তার দৈন্যতার কারনে। ভালোবাসা আর চিন্তার দৈন্যের কারণে একে অশ্লীল বা বিতর্কিত আমরা ভাবতেই পারি। কিন্তু সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে এ যৌনতা, প্রেম পরকীয়া (রায় ও অনন্যা: ১৪২৬বঙ্গাব্দ)। কিন্তু চিরন্তন এ সুড়সুড়ির অস্বীকার নয় বরং এতদ্বিষয়ে আলোচনা এখন বিশ্বায়নের যুগে প্রযোজ্যই বটে তা না হলে এ সংক্রান্ত ডিসকোর্স তৈরী হতো না বিদ্যাতয়নিক জ্ঞানকান্ডে (চৌধুরী:২০০০; নিউটন: ২০১৫)। যদিও এসবের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। আছে লুকোচুরির খেলা ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রবাহে দেহকেন্দ্রিক সংযোজন,যেখানে পুরুষতান্ত্রিকতার নির্মম আঘাতে নারীকে করেছে ক্ষতবিক্ষত। যৌনতা ও প্রেম সম্পর্কিত আলোচনা বিষয়ে আমাদের তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এক বিবর্তনীয় চিত্র পাই বাঙালীর জীবনে রমনী গ্রণ্থে।প্রেম, কাম, শ্লীলতা, আর অশ্লীলতার- উদাহরণ সমেত বিস্তারিত আলোচনার ধারাবাহিকতা আমরা আত্মঘাতী বাঙ্গালী গ্রণ্থেও পাই।
ভদ্র সমাজে যৌনতা নীতিগত দিক হতে এ বিষয়টি সকল সময় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বর্জনীয় কিংবা অপাঙ্তেয় আলোচনা। কারণ এটা নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনের একটি বড় বিনোদন। বিশেষত শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের মধ্যে অশ্লীল কথাবার্তা তাদের জীবনের অনুষঙ্গ। ভদ্রলোকেরা এ বিষয়ে সতর্ক এবং বহুক্ষেত্রেই নিজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (কবীর:২০১৪) এমন ভাবনার বহি:প্রকাশ আমরা চৌধুরীর (১৪২৩ বঙ্গাব্দ) লেখায় পাই প্রবলভাবে। অথচ এ সকল নিম্নবর্গীয় কন্ঠস্বরের উপস্থাপনা আমাকে তাড়িত করে যথেষ্টভাবে সময়ে কিংবা অসময়ে। অথচ মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তির দিক হতে অপরিহার্য বলে মনে করা হয় এই যৌনতাকে।যদিও বলা হয়ে থাকে যে,অবস্থান ও মর্যাদাভেদে এটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। তাই বলা হয় যে, ছোট লোকের কামে ও ভদ্র লোকের কামে তফাত আছে। সাধারন লোকের কাম স্বাভাবিক কিন্তু একেবারেই ছ্যাঁচড়া(চৌধুরী: ১৪২৩(ব):২৭) যাকে আমরা বলতেই পারি অশ্লীলতা(কবীর: ২০১৪)। যেই শ্রেণীভেদেই ঘটুক না কেন-ভদ্রলোক বা ছোট লোক-এই কাম বা যৌনতা বা অশ্লীলতা-কোনটিকেই কি কারো অস্বীকার করার মতো সাহস আমার,আপনার আছে? নাকি জীবনের এ সকল অপরিহার্য কার্যকে এড়িয়ে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো মূর্খ হিসেবে? সম্ভবতঃ কেউ করতে তা সম্মত হবে না। আর এমনটা করলে জীবনকেই তুচ্ছ করতে হবে। এই জীবনকে তুচ্ছ করার মতো-সৎ সাহস আমাদের নেই? অন্ততঃ এতটুকু বলতে পারা যায় যে, একেবারেই নেই বলে শতভাগ নিশ্চিত।
নিজের ভালোলাগার বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত হলেও অন্যের বিষয়ে সিকি ভাগও নই। তবে সন্দেহও নেই। যে নারীকে দেবতারাও পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। সেক্ষেত্রে আপনার বোঝার দায় না নিলেও আমার বোঝার চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। বাৎসায়ন নারী ও পুরুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে। কিন্তু নীরদ চন্দ্র চৌধুরী স্ত্রীদের তিন প্রকারে বিভক্ত করে ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি তাঁর বন্ধুর পথপরিক্রমায় তা উপলব্ধি করেন যা ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায় বলে উল্লখে করেন। এই তিন প্রকার স্ত্রী হলেন ---
- স্বীয়া
- পরকীয়া
- সামান্যবনিতা
এই তিন শ্রেণীর আলোচনার ব্যাখ্যা যাই থাকুক-আমাদের সমাজে প্রেম ভালোবাসার সাথে যৌনতার একটি সম্পর্ক আছে এবং পরকীয়া একটি উৎকৃষ্ট প্রেমের উদাহরণ হিসেবে অনেক বোদ্ধামহল মনে করেন। যদিও এ সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাতে সকল-সময়ে ও বিষয়ে সতর্ক আচরণ করতে হয় বলে নীরদ চন্দ্র হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এভাবে “যে কোনও দেশের ভদ্র সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ব্যাভিচার না স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কিত অন্যনীতি বিরুদ্ধ আচরণ কতটা পরিব্যপ্ত, তাহা নিরূপন করা সবসময়ই দুরূহ।” কারণ আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বরাবরই “বাহিরে ফিটফাট,ভিতরে সদরঘাট” নীতি অতি সর্ন্তপনে অনুসরন করে থাকি। আর এর ফলে অনাচার গোপন করা বা রাখাকে আমরা কর্তব্য বলে মনে করি। তাই উনিশ দশকের বিশশতকে শিখা পত্রিকায় পত্রিকায় (১৯২৬)-মূলমন্ত্র ছিল “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আদৃষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব”। ইদানিংকালেও কি আমরা যৌনতা চর্চার ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন আমাদের সামাজিক জীবনের অভ্যাস কিংবা অনভ্যাসে দেখতে পাই।
তাই, ভদ্র সমাজের না জানার ভাব ধরে রাখার মুশকিল হলো- এ বিষয়ে সঠিক সংখ্যার কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে, কানাঘুষা, নিন্দা, তামাশা, কেচ্ছা-কাহিনী আর ষোল প্রকারী পরিবেশনের মাধ্যমে আমরা যতটুকু জানতে পারি তাহার বিদ্যায়তনিকের ভাষায় নির্ভরতার তথ্য হতে পারেনা কিন্তু মনস্তাত্তিকের ভাষায় আশ্বস্ত তো হতে পারি। তাই,এরকম বিষয় সংশ্লিষ্ট তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্ক পরিবেশনের পাশাপাশি আমাদের মনে এও রাখতে হবে যে, ব্যক্তি বিশেষের অভিজ্ঞতায় সকল সময়ই একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই অর্জিত হয়ে থাকে, যা দর্শনের আরোহ কিংবা অবরোহ সূত্রানুসারে বৃহৎপরিসর বা জনগোষ্ঠীর কাজে লাগানো হয় বা বিচার করা হয় মাত্র। তাই যখন শুনি-
“ভ্রমর কইও গিয়া-
শ্রী-কৃষ্ণের বিচ্ছেদে অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে।
ভ্রমর কইও গিয়া।
কইও, কইও, কইও, রে ভ্রমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যামু- কৃষ্ণ ছাড়া হইয়ারে।
ভ্রমর কইও গিয়া
ভ্রমর রে -
আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর যাইব
রে ছাড়িয়া
আমার দেহের দুই ভাগ কইরা রাখিতাম
বান্ধিয়া রে
ভ্রমর কইও গিয়া।
ভ্রমর রে।
ভাইবে রাধা রমন বলে, শোনরে কালিয়া, নিভা ছিল মনের আগুন, কী দিলা জ্বালাইয়া রে- ভ্রমর কইও গিয়া।”
কূল রাই - এর এমন অনুভূতির পূর্বে শ্যাম যা বলেছিল -
“আমার আসিবার কথা কইয়া
মান করে রাই
রইয়াছ ঘুমাইয়া।
আমার কথা নাই তোর মনে
প্রেম করছ আয়ানের সনে
শুইয়া আছ নিজ পতি লইয়া।
আমি আর কতকাল থাকব রাধেগো
দুয়ারে দাঁড়াইয়া।”
রাধারমনের এ গানে আমরা রাধার প্রতি কৃষ্ণের অভিমান বুঝতে পারি। আরো জানতে পারি- রাধা তার নিজ স্বামী আয়ানের সাথে ঘুমাইয়া থাকলেও ইতঃপূর্বে অভিসারের কথা বেমালুম ভুলে গেছে বলে শ্যাম মনে করেন। শ্যাম এও মনে করেন-ঘন আধারে যমুনার ঘাটে তোমার আমার মিলনে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারতো; কারণ শাস্ত্রে বলে – “দূরাকীর্ণ ভূমি শয্যায় পরপুরুষ সঙ্গম নারীদের একান্ত প্রীতিকর (পূরবী:২০১৩:৮২)। সুতরাং বলা যায় যে, পরকীয়া একটি কেবল শিল্পও নয় বরং আত্মমোহনের মধ্য দিয়ে বিনোদনও বটে। যেটি নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। রাখাল বালকের এমন আবেদন গোয়াল কন্যা যে গ্রাহ্য করেনি তা নয়। বরং সেও অস্থির দূরাকীর্ণ ভূমি শয্যায় প্রীতিকর মিলনে। এমন একটি গান আমরা শুনতে পাই জসিম উদ্দীনের লেখায়--
“আমায় এতো রাত কেন ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে;
আমার নিভা ছিল মনের আগুন
জ্বালাইয়া গেলি রে।
---------------
শিয়রে শ্বাশুড়ী ঘুমাই, জ্বলন্ত নাগিনী
হায়রে হায় - জ্বলন্ত নাগিনী
আমার পইতানে ননদী শুয়ে- দুরন্ত নাগিনী
আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি।” (চৌধুরী:২০০০)
আদিমকাল কিংবা যুথবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তন প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায়, যৌথ পরিবার একটি অনুষঙ্গ উপাদান যা নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি বা এ বিজ্ঞানের বিদ্যাতয়নিক জানাশোনা অন্ততঃ তাই বলে। যেখানে স্বামীর সাথে স্ত্রী কিংবা স্বামীর অনুপস্থিতিতে শাশুড়ী, ননদ কিংবা অন্যরা ঘুমাবে এমন বাস্তব হালনাগাদ গ্রাম বাংলায় এখনও দেখা যায়। এমনও দেখা যায় যে,স্ত্রী অবশ্যাম্ভী প্রয়োজনে ঘরের বাহির হলে স্বামী কিংবা শ্বাশুড়ী অথবা ননদ অর্থ্যাৎ কেউ না কেউ সাথে থাকবে। সেখানে মাঝ রাতে রাধার একা ঘরের বাহির হওয়া, হাল নাগাদের কথা বিবেচনা করলেও দুঃসাধ্যও বটে।
অর্থ্যাৎ-শ্যামের আহবানে রাধার সাড়া দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় ছিলোনা। কারণ হিসেবে- জামাই, শাশুড়ী আর ননদীকে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রাতের আঁধারে ঘরের বাহির হয়ে দেখা করার অদম্য ইচ্ছাকে অবদমিত করতেই হয়। এ প্রেমের আবেগময় তাড়না, অভিমান একসময় পরিপূর্ণতা পায়, শ্যাম যখন গোকুল ছেড়ে চলে যান মথুরায়। আপাততঃ রাধা মান করলেও সেই অভিমান রাধা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। কারণ রাধা-কৃষ্ণের প্রাকৃতিক সম্পর্কের বন্ধনের দরুন শ্যামকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হলে, রাধা আর মান ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। বরং কূলবধুটি বিচ্ছেদে পীড়িত হয়ে তার সখিদের প্রতি অনুযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ করেন এভাবে ----
“সখি আমিই না হয় মান করেছিনু
তোরা তো সকলে ছিলি।
কেন নাহি ফিরাইলি।
-------------------
তোরা তো হরির স্বভাব জানিস
তার স্বভাবের চেয়ে পরভাব বেশি
তোরা তো হরির স্বভাব জানিস।
তার স্বভাব জেনেও রহিলি স্ব-ভাবে
ডাকিলি না পরবোধে।
তোদের পরমপুরুষ পরবোধে, ডাকিলি না পরবোধে।
তোরা তো চিনিস, হরিরে, প্রবোধ
কেন দিলি নে সই;
ডাকিলি না পরবোধে, ডাকিলি না পরবোধে।” (কাজী নজরুল ইসলামের কীর্তন)
হরির প্রেমে উন্মত্ত রাধা, আর রাখ ঢাক রাখেনি বরং নারীর সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে রাগ-অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। সমাজ-সংস্কৃতিতে ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে আমরা নারীজাতির যে চিত্র বা প্রতীক পাই, সেই হিসেবে নিঃসন্দেহে রাধা বিদ্রোহের বিমূর্ত প্রতীকও বটে। আজকের যুগের আলোকিত ও শিক্ষিত নারীর চেয়ে-নিজের যৌন স্বাধীনতা প্রকাশে অনেক অনেক দূর এগিয়ে বটে। আজকের নারীবাদীরা নারীমুক্তির যে সকল পন্থা বাতলে দিয়েছে, সে সকল বাতলে দেওয়া পন্থার মধ্যে যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা হলো যৌন দাসত্ব থেকে নারীর মুক্ত হওয়া। ঘরে স্বামী সংসার রেখে- জনে জনে প্রেমিকের ভালোবাসা খুঁজে ফেরা কিংবা তাতে পুনরায় আত্মীকৃত হওয়ার বিপুল বাসনা যা নারীমুক্তির আন্দোলনে প্রথম ঝাণ্ডাধারী নারী যে বিনোদিনী তা এ তথ্য ও তত্ত্বের আলোকে বলা যায়? সবকিছুরই যখন অরন্য রোদন হলো, তখন রাধা, কৃষ্ণকে অভিশাপ দেয় নারীর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে, যেখানে রয়েছে আত্মতৃপ্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা প্রতিশোধ স্পৃহা। শোনা যাক রাধার অভিশাপ বচনটি----
“তুমি আমারি মতোন জ্বলিও, জ্বলিও
বিরহ কুসুম হার গলেতে পরিও
তুমি যাইও যমুনার ঘাটে
না মানি ননদীর বাধা
বনমালি তুমি পরজনমে হইও রাধা।
তুমি আমারি মতোন কান্দিও, কান্দিও
বদনে কৃষ্ণ নাম জপিও
তুমি বুঝিবে তখন, ......
নারীর বেদন
রাধারও প্রাণে কতো ব্যথা।
তুমি আমারি মতোন মরিও মরিও
শ্যামও কলঙ্কের হার গলাতে পড়িও।
তুমি পুড়িও তখন
আমারি মতোন
বুকে লইয়া, দুঃখের চিতা।
আমি মরিয়া হইবো
শ্রী নন্দের নন্দন
তোমারে বানাবো রাধা।”
লোকায়ত কিংবা ফোকগানের ঢং এ অঙ্গের জ্বলুনিতে আপাততঃ জল কিংবা অভিশাপ বচনে সমাপ্তি হয়তো টানা যায় কিন্তু প্রশ্নটি যখন শুচিতার তখন এর উত্তর খোঁজার দায়ও পড়ে ।