এই ব্লগটি সন্ধান করুন

মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২

গবেষণা পদ্ধতিবিদ্যা -১

ভূমিকা কি আজকাল কেউ পড়েন!
 

বই এ সংযুক্ত ভূমিকা পাঠে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো সুখের নয়। ওজনদার ব্যক্তির সংযোজিত ভূমিকাও ইদানিংকালে,আমরা কেউ পড়তে চাইনা, নানাবিধ কারণে । তাই, গৎবাঁধা ভূমিকা দিচ্ছিনা, বা  কোন চুল পাকনা বুদ্ধিজীবির কাছেও যাইনি।  বদলে এমন শিরোনাম আকারে এই বইটি কি, কেন লিখার দরকার ইত্যাদি একটু প্রাথমিক আলাপ। আপনার কাছে বই-এর নামখানি অপ্রত্যাশিত। এমনকি চিন্তার জগতে উস্কানিমূলক। আদতে তা নয় বরং সাবলিলভাবে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কোয়ান্টিটিভ এথনোগ্রাফির সৌন্দর্য। কোয়ান্টিটিভ এথনোগ্রাফি শব্দদ্বয়ের দ্যোতনা আছে  এক দমে সহজিয়া  উচ্চারণ না একটু খটমটেনৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কির সময় থেকেই  পরিসংখ্যানএথনোগ্রাফি রচনার একটি সরঞ্জামসুতরাং এটি সম্পূর্ণ নতুন নয়[i] বরং, নৃবিজ্ঞানের যাত্রার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়তি। পূর্বেরটির পক্ষে পরেরটির বিশেষণ হওয়া অনেক নৃবিজ্ঞানের মাস্টারদের কাছে হাসিরউপাদান হতেই পারে! তবুও "কোয়ানটিটি/কোয়ালিটি" দুরতিক্রম্য ব্যবধানকে সংকুচিত করার সাহসী পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করেছি,এবং এই দুই গালফকে একটি মেল-বন্ধনে আটকে রাখতে চাইছি ধরে নিতে পারেন আমাদের সরল সিধা মতলব কিংবা বক্তব্য এইযে;কেনো সংখ্যার সাথে এথনোগ্রাফিক কাজের একটা সখ্যতা তৈরী করা যাবেনাজ্ঞানী লোকেরাআমরা দেখে আসছিনিজের মতোকিছু করার বদলে একটা ম্যালিনোস্কির মুখোশ বা গিয়ার্টজের গৎবাঁধা ব্যাখ্যায় আগ্রহ। আরো যারা 'গভীরতরজ্ঞানের মালিক হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় সংগ্রামরত, তারা  ফুঁকোদেরিদাঁ নিয়ে ব্যস্ত নাদোষের নাই কিছু তাতে  অন্ততঃ একদিকে তো আছি! কিন্তু যখনদেখিএকটা পুর্ণিমা চাঁদের ছবি দিয়ে 'আদিবাসীদের সাথে একটা নিবিড় সম্পর্কের’ প্রমাণ করার চেষ্টাতখন আশঙ্কা জাগে এই কারনে যে, বিষয়টির পঠন-পাঠনে ভুল করছি কি কোথাও? কিংবাএডাম কুপার যখন লিখে দেন ডিকলোনিয়াল নৃবিজ্ঞানীর বইয়েরভূমিকা! অজানা আতংকে সক্রিয় হয়ে উঠে মনে, চিন্তার বুদবুদ তখন মাথায় অনবরত আঘাত করতে থাকে এবং আমরা বিনয়ীরসুরেই বলতে চাইডিকলোনিয়াল গবেষণা প্রতিক, এলিগরিক্যাল কিংবা মেটাফোরও না যে কেতাবী নীতিগুলি এত প্রিয়ভাবে চর্চায়, ডিসকারসিভে  ধরে রেখেছেনতা হোক আপনাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস কিংবা অনভ্যাস কিন্তু প্রশ্ন হলো  আপনার অস্বচ্ছ জ্ঞানের বহর স্থানিক শ্রেণি কক্ষ বা বৈশ্বিক পাঠকের কাছে কেন পাঠাবেন?আপনার দায় আমি নিতে যাব কেন? জানিকারও সাথে কথোপকথনে  মেতে উঠার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয় কিংবা বিষয়গুলির পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকারসে 'বোবাশিক্ষার্থী হোনআর অজানা পাঠক’ হোন আপনার পঠিত গবেষণা পদ্ধতির সাথে  গ্রন্থের তুলনা আপনাকে বিব্রত করতে পারে, আমরা জানি সেটা, বরং কথোপকথনেরসুরে গল্প এবং হাস্যরসাত্মক উপায়ে আশা জাগানিয়া এ বইটিতে  কৌতূহলী পাঠক পিপাসা   মেটাবেন অনকেটাই কিংবাঅগ্রণীস্নাতক থেকে অধ্যাপকগণকে রেফার করবে ঢের বেশী এটাই একাডেমিয়ার সৌন্দর্য যা আমাদের এ বই লিখতে সাহায্য করেছে এবংএকাডেমিক বক্তৃতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিশ্লেষণের পাশাপাশি পরিসংখ্যান এবং পাঠ্য বিচারে  সংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়ার আবদারও আছেআমাদের

যা-ই হোকসামাজিকভাবে সমৃদ্ধ প্রসঙ্গগুলি সম্পর্কে এখন আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে উপাত্ত বিশ্লেষণ করার একটি পদ্ধতিতবে এটি এমনভাবে করা যাতে বিশেষত গুণগত গবেষণায়নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় বছরের পর বছর ধরে বিকশিত কঠোরতাসংখ্যার প্রতি 'বিমাতা সুলভ আচরণ  এবং 'বিদ্যালয়ি শৃঙ্খলারসম্মান দেখাতে গিয়ে আমরা হয়ে গেছি এক-একজন 'ডিসাইপল অব ডিসিপ্লিননিজের অজান্তেকিন্তু  পশ্চিমা ডিসিপ্লিনেরএবং তার নির্মাতাদের সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারেজানিয়াবুঝিয়া তারা আমাদেরকে 'ডিসাইপলকরে রেখেছেন। আর আমরা  একাডেমিকভাবেলার্নিং অ্যানালিটিকস সম্প্রদায়ের কাছে হয়ে গেলাম 'ক্যাপটিভ,' 'মিমিক,’ 'বঙ্গ বদনে চামড়ায় ম্যালিনোস্কির মুখোশ'এটির একদুইএবং তিন নম্বর সমস্যা। 

তালাল আসাদকে আমরা আরো স্মরণ করতে পারি

"কোন যোগ্যতা না-আমি আবার বলছি-আমি কি বলি যে নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতির তুলনায় পরিসংখ্যানের কোনও অপরিহার্যশ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে এথনোগ্রাফি সম্পর্কে আমি যে সাধারণ মতামত দিই তা ' নৃবিজ্ঞান সমৃদ্ধ আছে ট্রাডিশনালীটি আর   ঐতিহাসিকতা দিয়ে  ট্রাডিশনটাকে যদি ক্ষেত্রের কাজের ক্ষেত্রে কেবল সংজ্ঞায়িত করা হয় ,তবে তা বড় সংকীর্ণ হবে[ii]

 

এই আলোচনার দাবিটি ' বিশ্বায়িত বিশ্বের যুগে আমরা কেবল ম্যালিনোস্কিয়ান বর্ণনার উপর ভিত্তি করে নয়বা গিয়ারজিয়ান'থিক বিবরণদ্বারা নয়বা 'পাওয়ার-নলেজমডেল দ্বারা চালিত 'সমালোচনামূলকএবং হাই-ভোল্টেজের কথা দিয়ে বা এইসবেরসমন্বিত ভিত্তিতে কোনও সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি,  পরিবর্তেআমাদের ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য ডেটা/তথ্যের গুরুত্ব আলিঙ্গন করাদরকার যেখানে নৃগোষ্ঠিটি জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যেই পরিচালিত হবে আমাদের কাছে জানাডেটা তো ডেটাই ডেটাপ্রিফিক্সগুলিতে গুণমান বা পরিমাণগত কোনও মান থাকে নাযখন প্রতিটি পরিমিতির ডেটা গণনাগতভাবে মাপা যায়। আমরা এমনবিশ্লেষণগুলি চাই যেগুলি উভয়ই কঠোরভাবে ভিত্তি তৈরি করেছে (এথনোগ্রাফির মাধ্যমে আমরা ডিকনটেক্সটচুয়ালাইজশেন নাহওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ উপায় সরবরাহ করে), এবং সাধারনিকরণ যোগ্য (এটির জন্য শৃঙ্খলা সরবরাহকরার পরিসংখ্যান সহ) একটি মূল সংযোগের ধারণাটি ' সম্পৃক্ততাযেহেতু ভিত্তি বিশ্লেষণে তাত্বিক  সম্পৃক্ততা এবংপরিসংখ্যানগুলিতে নমুনা উভয়ই "ডেটাতেযা আছে তা এথনোগ্রাফিতে 'কোয়ালিটি-কোয়ান্টিটির বির্নিমানের  একটি সেতু বটে

কারা পড়তে পারেন

বইটি তিনটি আলাদা পাঠকগণের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে একযারা নিজেকে উভয়ই পরিসংখ্যান এবং গুণগত পদ্ধতিরকাছে নবাগত বলে বিবেচনা করেনকারণ এটি সত্যিকার অর্থেঅন্ততঃ আমাদের দেশীয়-পরিসরে কোনও পূর্ববর্তী জ্ঞান আহরণ করেনা দুইযারা ইতিমধ্যে একটি 'ওয়ার্ল্ড ভিউ'তে সাবলীললাইফ ওয়ার্ল্ড- নয়  (দু'টি সম্পূর্ণ আলাদা অর্থ বহন করেএবং আমরাপ্রথম অধ্যায়ের উপসংহারে আলোচনার রেশ রেখেছি মাত্র, এবং তৃতীয়তযারা ইতিমধ্যে গভীরভাবে আন্তঃশৃঙ্খলএবং আদিবাসীগবেষণা পদ্ধতির সাথে তাদের অনুভূতির  রেজোলিউশনগুলিকে তুলনা এবং সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী

 

তিন ধরনের পাঠককে বিবেচনায় এনে আমাদেরকে পা ফেলতে হয়েছে সাবধানে তথাপি সম্ভবত এটি পরবর্তী দু'টি দল একটু অসন্তুষ্টহয়ে যাবেন এই ভেবে যেতাদেরকে আমরা আরও উদ্বেগজনকআরও গভীরতার সাথে যুক্ত করে দিচ্ছি কি নাতবে বইটির ভবিষ্যতেরজায়গাগুলি পরিষ্কার করে দিবেসন্দেহ নেই; এবং আশাবাদ ব্যক্ত করছি পরবর্তী খণ্ড আমাদের সেই কথোপকথনটিকে আরো দৃঢ়তরকরবে যা’হোক, নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে যা হয়েছে, 'টেকেন ফর গ্র্যান্টেডবলে ছেড়ে দেওয়া ;যেমন নিজের সাথে নিজেই ইঁদুরবিড়াল খেলার নামান্তর দুইডিকলোনিয়াল নাম নিয়ে যে কাজ গুলি হচ্ছে গত এক দশকেমনে করার যথেষ্ট কারণ আছে-'ডিকলোনিয়ালিটিএকটা হাল ফ্যাশনের 'ট্রেন্ডীবা মেটাফোর।[iii] ডিকলোনিয়াল গবেষণা বালিক-বালিকাগণের 'যেমন খুশি তেমনসাজানয়, নিশ্চয়। কেননা,  শরীর-মন-চেতনার গভীরতম জায়গার উৎস থেকে এর জন্ম আর দুর্গম পাহাড়ের গায়ে বসে কাজ করারমাঝে এর প্রকাশ তাই, অনেকের খোলাচোখে  যুক্তিসঙ্গত  না হলেওআমাদের মনে করার যথেষ্ট কারন বিদ্যমান এবংএতগুলিবিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৮৬ সালে জাহঙ্গীর নগর বিশ্ববদ্যিালয়ে শুরু , পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববদ্যিালয়, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়) নবাগতদের দরকার এসব জানার মাস্টারগণ পড়বেনএবং পড়াবেন নতুন কিছু শিখাবেন মনে করে লিখছি কিংবা 'রাবিশবলেফেলে রাখবেন (সেতাও করতে পারেন); কারণ, ডাইনোসর যুগের নোট/ডায়েরি দেখে পড়াবেনকষ্ট করে নতুন আরেকখানা টপিক যোগকরার দরকারটা কি! (সবাই ননঅনুগ্রহ করে জেনারালাইজ করবেন নাআমরা আমাদের নিজেদের চোখকে তো আর অস্বীকারকরতে পারি না, ইম্পিরিক্যাল ডেটা থেকেই বলছি)। শেষ করা যায় আমাদের 'পয়েন্ট অফ ডিপারচার। কারণআরেকটাআলোচনা করলে তবেই একটা পরিস্কার ধারণা আসবে বিশেষ করে”আদিবাসী গবেষণা পদ্ধতি” নিয়ে দেশে তেমন আলোচনাহয়নি এখনোআমরা দেরিদাঁফুঁকো নিয়ে কথা বললে তবেই পড়ুয়া;জ্ঞানীঅনেক জানা মানুষ-ইত্যাদি কেতাবী খেতাব পাই। সমস্যাহল, 'অসংকোচ  প্রকাশের দুরন্ত সাহসদেখাতে কেউ রাজি নন, আমরা এই সাহস দেখানোর কাজটা করব। এখন তো নম্ব্র কম পাবার জানা ভয়টা নাই। যার ফলে জাগতিক আর বৈষয়িক বিষয়গুলো একেবারেই অস্বীকার করতে পারিনা।

আমরা হয়ে গেছি এক একজন 'ডিসাইপল অব ডিসিপ্লিন'

 

একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় বিবেচনা করা উচিত আমাদের তদ্ব্যতীততার আকর্ষণীয়অ্যাক্সেসযোগ্য স্টাইলের ভিত্তিতেউন্নত স্নাতকমাস্টার্স এবং ডক্টরাল প্রোগ্রামগুলির পাঠকদের জন্য এমন পরিমাণগত এবং গুণগত বিশ্বদর্শন আলোকিত করার উপায় হিসাবেসুপারিশ করা হয় যা একটি মানুষমানবিক আর রেসিপ্রোকাল এথনোগ্রাফি হয় যদিও হালের আমলে আমরা অন্তত দেশীয় পরিসরে এটি নির্দ্ধিদায় বলতে পারিযে,অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় নৃবিজ্ঞানও তার মূল জায়গা হতে সরে এসে কোর্স বা গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে বাণিজ্য, ক্ষমতা বা ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিয়েছেন বিশ্বায়ন বা ব্যক্তিজীবনের ভবিষ্যৎ নিশ্বচয়তা প্রদানের নিমিত্তে। এটাকে কি বলবেন? 

 

ডেভিড উইলিয়ামসন শ্যাফার বলেছিলেনতিনি এথনোগ্রাফি সম্পর্কিত কোনও বই নয় এটি পরিসংখ্যান সম্পর্কিত কোনও বই নয়আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানগত বিষয়গুলিও দেখবএবং এথনোগ্রাফির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলিও আলোচনা করব - এবং মূলত ব্যাখ্যামূলক বা গুণগত গবেষণা তবে মূলত এটি একটি বিগ ডেটা সম্পর্কিত পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণকে গাইড করারজন্য এথনোগ্রাফিক কৌশলগুলি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে একটি বই এবং একই সাথে এটি বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা এবংক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পরিসংখ্যান কৌশলগুলি কীভাবে ব্যবহার করতে হয় এটি একটি অনুসন্ধান এবং গবেষণার অন্যান্য গুণগতপদ্ধতি ঘটনা স্বীকার করুন।[iv]

 

আধুনিকীকরণ বিশ্বে পরিসংখ্যানের রাজনৈতিক সাফল্য যথেষ্ট নৃতাত্ত্বিক তাৎপর্যের সত্যতা এই উত্তরোত্তর দৃষ্টিকোণ থেকেএটি আধুনিক সামাজিক জীবনের একটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিশ্লেষণ করা এবং ব্যাখ্যা করার মতো কিছু যদি আমিপ্রস্তাব করি যে এই জাতীয়ানা বিশ্লেষণ পরিচালনা করা হয়তবে এটি অনুসরণ করে না যে আমি মনে করি যে নৃতাত্ত্বিক ফিল্ডওয়ার্কের কোনও যোগ্যতা নেই "(p.79)

 

 

মৌলিকভাবেএই বইটি ডেটা পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ পরিচালনার জন্য কীভাবে নৃতাত্ত্বিক কৌশলগুলি ব্যবহার করতে পারে সেসম্পর্কে একই সাথেএটি নৃতাত্ত্বিকতার ক্ষেত্র এবং ক্ষমতা এবং গবেষণার অন্যান্য গুণগত পদ্ধতির প্রসার করতে কীভাবেপরিসংখ্যান কৌশলগুলি ব্যবহার করবেন তার সন্ধান করে এটি ডিজিটাল যুগগুণগত এবং পরিমাণগত গবেষণা পদ্ধতির মধ্যেবিজ্ঞান  মানবতার মধ্যেএবং সংখ্যা এবং তা বোঝার মধ্যেযে প্রশ্নগুলি আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারিকিছু ক্ষেত্রে আমাদরকে সীমাবদ্ধ করে তথাপি কোয়ান্টেটিভ এথনোগ্রাফি এমন একটি গবেষণা পদ্ধতির 'পরিপুরকযা আমাদের ক্রমবর্ধমান ডেটা সমৃদ্ধ বিশ্বেকীভাবে আমাদেরকে স্থান করে নিতে পারেতা বুঝতে  সার্বিক সহায়তা করবে

 

হালনাগাদ, ২০২০ সালের কোভিড-১৯,মহামারী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি করোনা-১৯ভাইরাসজনিত মহামারীসংঘটিত বর্ণবাদ এবং জেনোফোবিয়া বিশ্বব্যাপী অভিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অসাধারণভাবে প্রভাবিত করেছে বৈষম্যএবং বৈষম্যের বিদ্যমান নিদর্শনগুলিকে আরও বাড়িয়ে তোলেযার দরুন সামাজিকঅর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার মুখোমুখিহচ্ছেন অনেকেই  সংখ্যা এবং বর্ণনার মিশ্রণ ছাড়াই আমরা কীভাবে এটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি?[v]  

 

 মহামারীর উদাহরণ বিবেচনায় নিতে পারি এই ভেবে যেদুনিয়ার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কাল রুপটি আমরা দেখতামই না, যদিমহামারিটি আসতো!  সুতরাংদুনিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেনআদিবাসীদের নিয়ে আলাদা করেভাবতে হবে খুবই সময় সংশ্লিষ্ট আহবান কিন্তুআমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেখানে আদিবাসী- নাইসেখানে এমন একটা বৈশ্বিকডাকে সাড়া না দিলেই পারি? এই বইটি  গুণগত এবং  পরিমাণগত দ্বৈরথের মরীচিকাকে একটু হলেও কাটাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।[vi]

 

যদি আমরা কোভিড-১৯ দ্বারা চিহ্নিত বর্ণবাদের প্রকৃতি এবং ব্যাপ্তিটি সন্ধান করিসন্দেহাতীত ভাবেইআমাদেরকেপরিসংখ্যানেরসাহায্য নিতে হবে আমরা ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ থেকে যদি আলোচনা করতে পারতাম, তাহলে  বড়ো ভালো হতো ঐতিহাসিকভাবেই,  মহামারী এবং বর্ণবাদী অনুভূতির মধ্যে সম্পর্কের জন্য প্রিসম্যান দরকার এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জাতিগত  বর্ণগত বৈষম্যেরবেলায় আরো জরুরী তারপরেওপ্রায় আমরা বেয়াড়া বক্রির মতো করে বলবোএথনোগ্রাফিক কাজে পরিসংখ্যান দরকার নাই। ইতিহজাক গোল্লায় যাক। আমাদেরকে প্রকৃত সংখ্যাটি চিহ্নিত করতে হবে এবং এই সংখ্যাসূচক পরিসংখ্যানগুলি কোভিড-১৯ এরঅধীনে বর্ণবাদকে প্রাসঙ্গিক রূপে এথনোগ্রাফিতে নেয়া যেতে পারে যুক্তি হলো জনপ্রিয়তাপুনরুত্থিত বর্জনীয় জাতিগোষ্ঠী-জাতীয়তাবাদ এবং পরিবেশবাদের পশ্চাদপসরণ একটি বর্ণবাদ বৈষম্যবাদের মূল অবদান ছিল কভিড-১৯ এর সময়। আমাদেরআলোচনা ২০২০ সালের মহামারীকে কেন্দ্র করে নাতবেরেফারেন্সের পয়েন্ট হিসাবে আমরা এরপরে বর্ণবাদজাতীয়তাবাদ এবংপুঁজিবাদের মধ্যে যোগসূত্রগুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারি, এবং মৃত্যুর পরিমাণ সম্পর্কে বিবেচনা করতে পারি  এই মহামারীটিরেফারেন্স হিসাবে উল্লেখ করার দরকার ছিলঅন্যথায় সম্ভবতঃ আমাদের এই বইটি 'পুরোপুরি সময় ঘনিষ্ঠবলে যে  দাবিতা  যথাযথ হতোনা   

একটি দায় এবং কৈফিয়ত

এখানেআমরা দুটি বিষয়ের জোর দিতে চাই ডিকলোনিয়াল পণ্ডিত ফারিদ আলাতাসকে মনে করি। প্রথমতএটি নির্দিষ্ট সমাজ বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয় যাদের আমরা সাইলেন্সার হিসাবে চিহ্নিত করেছি তারা হলেন বৈশ্বিক জ্ঞান উৎপাদনেরবৃহত্তর সমস্যার নিছক চিত্রণঅর্থাৎ বৌদ্ধিক সাম্রাজ্যবাদ এবং একাডেমিক নির্ভরতার প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট বক্তৃতার প্রান্তিককরণ দ্বিতীয়ত কথাটি বলা দরকার যে আমরা যে লেখকদের নিরব বক্তব্যগুলির অংশীদার হিসাবে উল্লেখ করি, তাদের লেখকদের প্রতি যা কিছুদায়ি করা হয়েছে তা নিরব করার জন্য কোনও উদ্দেশ্যমূলক উদ্দেশ্য নেই আমাদের মূল উদ্বেগ সাইলেন্টের প্রভাব এবং কার্যকারিতানিয়ে যা নির্দিষ্ট বক্তৃতার প্রান্তিককরণ বজায় রাখা

 

ঔপনিবেশিক কর্তৃক উপনিবেশের আদর্শ গ্রহণ করা বন্দী মনের সর্বব্যাপীত্বের প্রতিচ্ছবি, "বাহ্যিক উৎস দ্বারা প্রভাবিত ,অবরুদ্ধ অনুকরণীয় মনযার চিন্তাভাবনা একটি স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্ছিন্ন"।১০ বাহ্যিক উৎস, পশ্চিমা জ্ঞান এবং একাডেমিয়া, যাবৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকলাপের সমস্ত স্তরে যেমন সমস্যা-নির্বাচনধারণাবিশ্লেষণসাধারণিকরণবিবরণব্যাখ্যা এবংব্যাখ্যা করে।১২ মূলবিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি তৈরি করতে অক্ষমতা এবং আদিবাসী সমাজের মূল বিষয়গুলি থেকে বিচ্ছিন্নতা বন্দী মনটি পুরোপুরি পশ্চিমাবিজ্ঞানগুলিতে প্রশিক্ষিত হয়, পাশ্চাত্য লেখকদের রচনাগুলি পড়ে এবং পশ্চিমা শিক্ষকদের দ্বারা যা মূলত পড়ানো হয়তা পাশ্চাত্যেইহোক বা তাদের স্থানীয় শিক্ষাগত কেন্দ্রে উপলব্ধ কাজগুলি দ্বারা সমাধান এবং নীতিমালার পরামর্শে মানসিক বন্দিদশাও পাওয়াযায় তদ্ব্যতীতএটি তাত্ত্বিক পাশাপাশি অভিজ্ঞতাগত কাজের স্তরে নিজেকে প্রকাশ করে আলাতাসও পরামর্শ দিয়েছিলেন যেঔপনিবেশিকদের চিন্তাভাবনার পদ্ধতিটি সমান্তরাল রাজনৈতিক  অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের সুতরাং, "একাডেমিক সাম্রাজ্যবাদঅভিব্যক্তিসেই প্রসঙ্গে যা বন্দী মন উপস্থিত হয়



[i] Driver, H. E. (1953). Statistics in anthropology. American Anthropologist55(1), 42-59; Clements, F. E. (1928). Quantitative method in ethnography. American Anthropologist30(2), 295-310; Wallis, W. D. (1928). Probability and the diffusion of culture traits. American Anthropologist30(1), 94-106.

[ii] Asad, 1994, p.79; Trnka, B. (1950). A tentative bibliography (Vol. 1). Spectrum Publishers.

[iii] Tuck and Yang, 2012.

[iv] Asad, 1994, p.79.. 

[v] Sherman, L. W., & Strang, H. (2004). Experimental ethnography: The marriage of qualitative and quantitative research. The Annals of the American Academy of Political and Social Science595(1), 204-222.

[vi] Schnaider, K., Schiavetto, S., Meier, F. M., Wasson, B., Allsopp, B. B., & Spikol, D. (2020). Governmental Response to the COVID-19 Pandemic: A Quantitative Ethnographic Comparison of Public Health Authorities' Communication in Denmark, Norway, and Sweden. In ICQE: International Conference on Quantitative Ethnography 2020;

সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০২২

কাপুরুষ (COWARD)

                                       

                                                                      মূলঃ  Sadat Hasan Manto 

[নোটঃ উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন –‘লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি (“If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।” ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও, দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন – আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব –কে বড় ছোট গল্পকার —আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!]

দিকে সাভার, ওদিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লী; মাঝখানে প্রমত্ত পদ্মা নদী। শীতের সকালে বেড়িয়ে পৌঁছালো সেই গোধূলি বেলায়,ভাবছিল রাতের কাম দিনেই শেষ করে সাভারে ফিরবে সন্ধ্যা বেলায়।তা আর হয়ে উঠল না তার। পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অভ্যাস মতো যানজট আজকে তাকে এখানে নিয়ে আসল প্রায় ৫ ঘণ্টা পর। গাড়ী থেকে নেমে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট কিনে আগুন দিলো তাতে; একটু এগিয়ে যেতেই সে বাঁশের পুলটা দেখতে পেল। না এবারই প্রথম নয়। এখানকার ঘরগুলো, রাস্তা, এমনকি ল্যাম্প পোস্টের বাল্বগুলোও তাকে চিনতে পারে, যদি না পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের বদলিয়ে থাকে; ভাবছে ধীরে ধীরে এগুবে সে। খালের ধারে মাঠটি পরিষ্কার আর ফাঁকা আছে, শীতের গোধূলি তাই হাল্কা কুয়াশা পরছে বলে মনে হয়। ডঃ জারিফুর রহমান পি এইচডি, একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে হন হন করে হেঁটে বাঁশের সাঁকোটি পার হতে না হতেই, হাতের সিগারেটটিকে পায়ের তলায় পিষিয়ে মারল, যেভাবে সে নিজের বিবেক, নীতি,মূল্যবোধ,আর চরিত্রকে পিসে ফেলেছে ৫০ বছর আগে। এ জন্যই কেউ কেউ তাকে জাউরা জারিফ বলে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যে; ডঃজারিফ নিশ্চিত যে মিউনিসিপ্যালিটির ল্যাম্প পোস্টে লাগানো বৈদ্যুতিক বাতিটি তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে। সে দেখতে পেলো একটা খোলা উঠান— ভাগাড়ও বটে, কত শিশু! হয়তো এরাও আজ আমার মতো খয়রাতি টাকায় পি এইচ ডি করে নামের আগে ডঃ আর পিছে পি এইচ ডি লিখতে পারতো! যাকগে। সে এগুতে লাগলো ; পাতলা, মোটা , হাল্কা অথবা ভারী নিতম্বের নারীরা এখানে, ওখানে শুয়ে আছে কেউ বেঞ্চে, কেউ খাটে। নানা জন, নানা বর্ণ, হরেক রকম সাজ,ক্রিস-ক্রস ফ্যাশনে পাকা, সামনে এবং শুয়ে আছে – যেন সাদা কালো ভুবন থেকে দূরে আরেক রঙ্গিন জগতে আসলো। সে উঠোন পেরিয়ে কোণার বাড়িতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু সেই বাল্বটি যেটি তার অস্পষ্ট সূঁচ-তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার সংকল্পকে নড়বড় করে দিল এবং সে কয়েক পা দূরে বড় বাড়ীটি হতে; এ বাড়ীর পাশেই একটি ছোট নর্দমা। এ নর্দমা দিয়েই পৌর কর্তৃপক্ষ যৌন পল্লীর নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধরে রাখছে। নর্দমা পেরিয়ে উঠান পার হতে মাত্র কয়েক কদমের ব্যাপার। তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়ীটি।
জারিফুর রহমান সেই সাভার হতে যানজটের তীব্র যন্ত্রণা পেরিয়ে কিন্তু এখানে পৌঁছে গিয়েছিল। তার চিন্তা,তার পদক্ষেপের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলছিল। চলতি পথের মাঝে অনেক কিছুতেই তার মন বসছে না। না সে কোন অস্থির প্রকৃতির মানুষ নয়। সে খুব ভাল করেই জানত যে সে একজন পতিতার কাছে যাচ্ছে এবং কেন সে তার কাছে যাচ্ছে তা সে আরও ভালভাবে জানতো।
তার দরকার একজন নারী—একজন নারী, তা সে যে ধরনের নারীই হোক না কেন— বুড়ি, ছুড়ি, কচি, ডিভোর্সি , মোটা,কালো, ফর্সা। একজন নারীর প্রয়োজন হঠাৎ করে দেখা দেয়নি; এটিই তার বর্তমান রূপ; না পাওয়া পর্যন্ত সদা তৎপর থেকেছে – বাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কর্মক্ষেত্রেও সে সুযোগ্কে হাত ছাড়া করেনি। হঠাৎ, কেন জানি তার মনে হল যে সে আজ একজন মহিলা ছাড়া আর একটি মুহূর্তও বাঁচতে পারবেন না। এমনটা মনে হলেই সে প্রমত্ত পদ্মা পাড়ি দিয়ে এখানে চলে আসে। তাকে অবশ্যই একজন মহিলা পেতে হবে – এমন একজন মহিলা, যার ঊরুতে সে হালকা থাপ্পড় মারতে পারবে, যার কণ্ঠস্বরে সে শুনতে পাবে যৌনতা, এমন একজন মহিলা, যার সাথে সে সবচেয়ে অশ্লীলভাবে কথা বলতে পারবে।
জারিফ একজন শিক্ষিত, বিচক্ষণ ধরনের মানুষ; চাকরি করেন। সে অধিকার-অন্যায় জানে।কিন্তু এ বিষয়ে আর ভাবতে পারছিলনা। তার গভীরে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল; এটা কোনোভাবেই নতুন ইচ্ছা ছিল না। এটি এর আগে বেশ কয়েকবার মাথা চাড়া দিয়েছিল এবং প্রতিবার তার পক্ষ থেকে অসংখ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও হতাশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। পরাজিত হয়ে, সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে সে একজন নারী না পাওয়া পর্যন্ত সন্ধান চালিয়ে যাবে।সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠল এবং কোন একদিন দেখা যাবে যে সে একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকা কোনও মহিলার উপর আক্রমণ করে বসতে পারে; ঠিক যেমন একটি পাগলা কুকুর যে কোনও পথচারীকে কামড়াতে পারে।
এতক্ষণে সেই প্রতিচ্ছবি তার মন থেকে চলে গেছে – একজন মহিলার প্রতিমূর্তি যার ঠোঁটে, সে ভেবেছিল, সে ফুলের উপর প্রজাপতির মতো করে নিজেকে বিশ্রাম দেবে। এবার সে তার গরম ঠোঁট দিয়ে সেই ঠোঁটগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে চাইল। মহিলার কানে মিষ্টি কিছু বকবক করার চিন্তাও তাকে এতক্ষণে ধরে বসেছে। সে জোরে কথা বলতে চেয়েছিল- যা নগ্ন ছিল।
এখন তার মনে একক, সম্পূর্ণ একটি সেক্সি নারী। সে এমন একজন মহিলাকে চায় যাকে দেখতে সেক্সি মনে হয়। সে আসলে এমন একজনকে খুঁজছিল সে হবে অর্ধেক মহিলা এবং অর্ধেক পুরুষ ।
একটা সময় ছিল যখন জারিফ ‘নারী’ শব্দটি মুখে নিলেই তার চোখে এক বিশেষ ধরনের আর্দ্রতা অনুভব করত, বিশেষ অঙ্গে ভেজা অনুভব করতো; যখন নারীর কথা ভাবলেই সে আনমনা হয়ে যেত। সে উচ্চারণ করত – ‘নারী’ – অত্যন্ত যত্ন সহকারে, যেন এই নিষ্প্রাণ শব্দটি অসতর্ক উচ্চারণে ভেঙে যেতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে সে এই নির্ভেজাল আনন্দটি উপভোগ করে চলেছে আজ অবধি।
জারিফ এবার স্বপ্নের জগৎ ছেড়ে বাস্তবে। অনেক দিন ধরে সে তার এলোমেলো চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু এখন তার শরীর ভয়ানকভাবে জেগে উঠেছে। তার কল্পনার দ্রুততা তার শারীরিক সংবেদনগুলিকে অনুভূতির এমন সূক্ষ্ম অঞ্চলে পরিণত করেছিল যে, জীবন তার জন্য সূঁচের বিছানায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি চিন্তা এক একটি বর্শায় পরিণত হয়েছে এবং কল্পিত মহিলাটি এমন একটি আকৃতি ও রূপ ধারণ করেছিল সে চাইলেও, তার বর্ণনা করা কঠিন ছিল।
জারিফ একসময় মানুষ ছিল; কিন্তু এখন সে মানুষকে ঘৃণা করে, এতটাই যে সে নিজেকেও ঘৃণা করে এখন। আর সেজন্যই সে নিজেকে এমনভাবে হেয় করতে চায় । সে বলে উঠে — “আমি নিজেকে পরিমার্জনা করতে ব্যর্থ হয়েছি, কারণ আমার চারপাশেই নোংরা। আমি এখন এই ময়লা দিয়ে আমার দেহ ও আত্মার প্রতিটি পরমাণু এবং ছিদ্র ধ্বংস করতে চাই। আমার নাক, যেটা একসময় সুগন্ধের খোঁজে বেড়াতো এখন সেটা দুঃগন্ধ শুঁকবার আশায় কাঁপছে। আর তাই আজ পুরানো চিন্তার চাদর ত্যাগ করে এই পাড়ায় চলে এসেছি, যেখানে সব কিছু একটা রহস্যময় দুর্গন্ধে ঢেকে আছে। এই পৃথিবী ভয়ংকর সুন্দর! আমি এখানেই স্নান করবো ।”
বাতির আলোয় জারিফ ধান্দার চোখে উঠানের দিকে তাকাল। দেখে মনে হয়েছিল যেন বেশ কিছু নগ্ন মহিলা সেখানে শুয়ে আছে-কারো খোলা পিঠ, অন্যরা মুখ নিচু করে; এলো মেলো শাড়ি আঁচল, অন্তর্বাস খুল্লাম খুলা ।সে সংকল্প করল কোনমতে মাঠ পেরিয়ে কোণার বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির বাল্বটি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে এগুবার সাহস না পেয়ে পিছিয়ে গেল এবং থমকে দাঁড়ালো। ব্যর্থ হয়ে ভাবতে লাগলো —“ বাতিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? কেনইবা আজ পথে পথে পাথর ছড়ানো।“
সে জানত যে এটি তার কল্পনার ছবি এবং বাস্তবতার সাথে এর কিছুই মিল নেই। তবুও, সে পিছু হটল এবং সে তার মাথার সমস্ত কুৎসিত চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলার জন্য নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল যে যে বিগত পঞ্চাশ বছরের এই দ্বিধা যা তাকে উত্তরাধিকার হিসাবে দান করা হয়েছিল সেটা আজ বাতির মধ্যে ঢুকে গেছে। সেই সঙ্কুচিত দ্বিধা, যা সে ভেবেছিল সেই ফেলে আসা দ্বিতীয় চামড়ার মতো বাড়িতে রেখে আসা মুখোশ, তার আসার অনেক আগেই এখানে পৌঁছে গেছে –এখানে সে তার জীবনের সবচেয়ে নোংরা খেলা খেলতে চলেছে। এমন একটি খেলা যা তাকে পতিতাদের বিসটা দিয়ে ঢেকে দেবে এবং তার এ দিয়েই তার আত্মাকে করে ফেলবে পুত -পবিত্র ?
এই বাড়িতে এক মধ্য বয়স্ক মহিলা বাস করে ।সে সকল সময় কালো চশমা পরে থাকে; তার সাথে চার-পাঁচজন যুবতী থাকে , এরা রূপের পসরা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে – তা দিনের আলোতে হোক বা রাতের অন্ধকারে। এই মহিলারা সারা দিন রাত মেশিনের মতো কাজ করে। এক বন্ধু জাউরা জারিফকে তাদের কথা বলেছিল, সেখানে অসংখ্যবার প্রেম ও সৌন্দর্যের লাশ দাফন করতে দেখেছে সে। বন্ধুটি জারিফকে বলত, “যখনই আমি একজন মহিলার প্রয়োজন অনুভব করি তখনই আমি দৌলতদিয়ার পতিতালয়ের সবচেয়ে পছন্দের সঙ্গী খুঁজে পাই। ঈশ্বরের কসম, এখানকার নারী যেন নারী নয়; এক একটা ডানা কাঁটা —-! আল্লাহ যেন তাকে কেয়ামত পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখেন!”
চার-পাঁচজন নারীর মধ্যে জারিফের মনে বিশেষ কোনো কিছু নাই। “আমি কোনটা পাব তাতে আমার আপত্তি নেই। আমি নগদ টাকা তুলে দিবো আর বিনিময়ে দু দণ্ড শান্তি নিয়ে সাভারে ফিরে যাবো! … একজন মহিলাকে আমার হাতে তুলে দিলে , আমার এক সেকেন্ড বিলম্ব করা উচিত নয় । কোন অলস সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পরা উচিত। সামান্যতম ভদ্র কথোপকথনও নয়। ধরো তক্তা, মারো পেরেক অবস্থা।“
অস্থির হয়ে ওঠে ডঃ জারিফ। তার মধ্যে একটা কোলাহল ওঠে। সে এখন এতটাই দৃঢ়ভাবে মনস্থির করে ফেলেছে যে, যদি পাহাড় তার পথ বন্ধ করে দেয়, সেগুলিও সে ডিঙ্গিয়ে ওই বাড়িতে যাবে। কিন্তু মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের লাগানো বাতি, যা বাতাসের স্বল্প ঝাঁকুনিতে ছিঁড়ে যেতে পারে, সেই বাতির আলো তার সামনে একটি অপ্রতিরোধ্য বাধা হয়ে দাঁড়ালো। জারিফুর রহমান, নিজের লালিত অভ্যাস মতো পৌর কর্তৃপক্ষকে গালাগাল দিতে না দিতেই বাতিটি যেন প্রতিধ্বনি করতে লাগলো – “জারিফ তুই একটা খবিশ?”
সে দেখতে পেলো পাশেই একটা পানের দোকান খোলা। আলো ছিল। নগ্ন বাল্বের আলোর চারপাশে মাছিগুলো ভনভন করে যেন তাদের ডানাগুলো আগুণখেকো হয়ে গেছে। জারিফ মাছিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখার পর তার জ্বালা যেন বেড়ে গেল। ‘এটা করার’ সংকল্প, যা নিয়ে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। বারবার সেই মাছিগুলির সাথে পরস্পরের সংঘর্ষের ধাক্কা তাকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে তার মাথার ভিতর একটা ঝড় বয়ে যেতে থাকে। “আমি ভয় পাচ্ছি… আমি আতঙ্কিত… আমি আলোকে ; বাতিকে ভয় পাচ্ছি… এটা আমার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে ! আমি কাপুরুষ… আমি কাপুরুষ… আমার লজ্জিত হওয়া উচিত আমার নিজের জন্য।“
জীবনের কিছু চিহ্ন তখনও জারিফুর রহমানের সামনে, অর্থাৎ অন্য দিকে দৃশ্যমান ছিল পতিতালয়ের দোকানগুলোর উপরে সারিবদ্ধভাবে যৌনশিল্পীদের ঘর খানিকটা খালের ওপাশে। সরাসরি তার সামনে, একটি কালোমতন মহিলা একটি জানালার পাশে বসে একটি বৈদ্যুতিক আলোর তীক্ষ্ণ ঝলকানিতে নিজের উন্নত বক্ষ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। একটি নগ্ন বাল্ব সরাসরি বেশ্যার উপরে ঝুলছে এবং ঠিক যেন আগুনের একটি সাদা-গরম বলের মতো দেখাচ্ছিল যা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এবং জারিফুরের মাথার উপর দিয়ে গলে গলে পরছে ।
জারিফ সেই কালো মহিলার কথা গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করছিল যখন সে বাজারের দূরপ্রান্ত থেকে কিছু মোটা কণ্ঠস্বর সবচেয়ে অশ্লীল শ্লোগান শুনেছিল সে দাঁড়িয়ে ছিল বটে কিন্তু ওই প্রান্তটি তার কাছে দৃশ্যমান ছিল না। কিন্তু অশ্লীল কিছু শব্দ আর গালাগাল কানে এসেছিল।
জারিফ এখন নিজেকে আগের চেয়ে বেশি তুচ্ছ মনে করতে লাগলো। “তুমি… তুমি… তুমি… তুমি কী? আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি … সব পরে, তুমি কি? তুমি এও নও ,ওটাও নও… তুমি মানুষও নও, জানোয়ারও না… তোমার শিক্ষা, তোমার পি এইচ ডি, তোমার বুদ্ধি, তোমার ভালো থেকে মন্দ বলার ক্ষমতা- সবই নষ্ট হয়ে গেছে। দেখ , তিনজন মাতাল লোক আসে। তোমার মত নয়, তারা কোন স্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আসেনি। কিন্তু কোন ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই, তারা বেশ্যার সাথে কথা বলে, তারা হাসে, তারা খুনসুটি করে এবং তারা আমার খাদে উঠে যায় ,আমার নদীতে সাঁতার কাটে ইচ্ছেমত; যেমন সহজ … যেন তারা একটি ঘুড়ি উড়াতে যাচ্ছে। আর তুমি… তুমি… তুমি…. ভালো করেই জানো, তোমার কী করা উচিত, বাতির ভয়ে বাজারের মাঝখানে স্টুপিডের মতো দাঁড়িয়ে থাক! তোমার ইচ্ছা ,এতই পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ, তবুও তোমার পা তোমাকে এগিয়ে নিতে অস্বীকার করে… তোমার লজ্জা!’ এটা তোমার কাপুরুষতা।“
পতিতার এমন খেদোক্তিতে এক মিনিটের জন্য নিজের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা তার মধ্যে জেগে উঠল। তার পা কেঁপে উঠল এবং সে সরে গেল, এক লাফে নর্দমা পার হয়ে পতিতালয়ের দিকে যেতে লাগল। সে সিঁড়িতে উঠতে চলেছে এমন সময় একজন লোক নেমে আসছে। জারিফ দ্রুত পিছিয়ে গেল। সে নিজেকে আড়াল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা লোকটি তাকে কোনও কর্ণপাত করলো না ।
লোকটি তার মূল কুর্তা খুলে তার কাঁধে রেখেছিল। তার ডান হাতের কব্জিতে সুগন্ধি। ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে। জারিফের অস্তিত্ব অস্বীকার করে লোকটি উঠান পেরিয়ে নর্দমা লাফিয়ে চলে গেল। জারিফ ভাবতে লাগলো কেন লোকটা তার দিকে একবারও তাকালো না।
এদিকে, সে বাতির দিকে যেই তাকাল অমনি প্রতিধ্বনি শুনতে পেলো— “তুমি কখনই তোমার পরিকল্পনায় সফল হবে না কারণ তুমি কাপুরুষ। তোমার কি মনে আছে, গত বছর, যখন তুমি তোমার সহকর্মীটিকে বউ ঘোষণা করেছিলে, মেপেছিলে শরীরের ভাঁজ, কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই তোমার শরীরের প্রতি আউন্স শক্তি কেমন করে হারিয়ে গিয়েছিল? তুমি কতটা ভয় পেয়েছিলে? ক্যান্টনমেন্ট এ ডেটিং করতে গিয়ে এমপি পুলিশের কাছে থতমত খেয়ে ভয়ে কাপড় ভিজিয়েছিলে কিংবা তোমারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পরে তুমি সাহস দেখাতে পারনি? মনে আছে? সেই চিন্তা কীভাবে তোমাকে ভয় দেখিয়েছিল? তুমি ভয় পেয়েছিলে? আজ আমি দেখব, তুমি সিঁড়ি বেয়ে কিভাবে উপরে উঠো … আমি দেখব তুমি কিভাবে সাহস যোগাও।“
জারিফের সংকল্পে যা কিছু ছিল তা নিমিষেই উবে গেল। তার মনে হতে থাকে যে সে সত্যিকারের প্রথম শ্রেণীর একজন কাপুরুষ। অতীতের ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে একে একে ।তার মন, বইয়ের পাতার মতো একটা তীব্র দমকা হাওয়ায় এবং প্রথমবারের মতো সে সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলো যে তার অস্তিত্বের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অস্থিরতা লুকিয়ে রেখেছে এবং এটি তাকে করুণ কাপুরুষে পরিণত করেছে।
সিঁড়ি দিয়ে কারো নামার শব্দ জারিফুর শুনতে পেলো । সে কেঁপে উঠলো। একটি মেয়ে যে রাতেও কালো চশমা পরেছিল এবং যার সম্পর্কে সে তার বন্ধুর কাছ থেকে অনেক কিছু শুনেছিল। জারিফ ঘাবড়ে গেল। সে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো; মেয়েটির দরাজ কণ্ঠে জারিফ ভড়কে গেলো , “তুমি, ওখানে কেন সোনা , একটুও … ভয় পেওনা, আমার ভালোবাসা… এসো… এসো ।“ সে এবার জোরে ডাক দিল, “এসো… এসো।“
সে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো , আবার শুনতে পেলো , “এসো, আমার প্রিয় সোনা, এখন এসো।“
জারিফ দৌড় দিলো আতংকগ্রস্থ হয়ে। লাফিয়ে নর্দমা পার হতে গিয়ে, সে নর্দমার মাঝখানে উপুড় হয়ে পরে গেলো;পুরোমুখ পতিতাদের মলমূত্রে ভরে গেলো।

রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২

হুজুরের বয়ানগুলো বদলে গেল কেন-২?

 

উর্দু ভাষার খ্যাতিমান গল্পকার Sadat Hasan Manto এর নামে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ আনলে; তিনি বলেন - 'লেখায় অশ্লীলতা থাকলে বুঝতে হবে, আমরা সেই সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি ("If you find my stories dirty,the society you are living in is dirty. With my stories, I only expose the truth)।" ব্রিটিশ সরকার তাকে শাস্তি দিতে না পারলেও , দেশান্তরিত মান্টোকে পাকিস্তান সরকার ঠিকই এ অপরাধে তাকে সাজা দেন । পাকিস্তানে বসে মান্টো লিখেন - আমার মৃত্যুর পর আমাকে পুরস্কৃত করা হবে, আর সেদিন আমি বিজয়ী; হেসে বলব - কে বড় ছোট গল্পকার — আমি না ঈশ্বর ? হয়েছিলও তাই!
প্রসঙ্গটি মান্টো নন; বয়ান। আমরা এই সময়ে বয়ানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরাই কি বয়ান নির্ভর সমাজ বিনির্মাণের সুযোগ করে দেইনি? নির্বাচিত কয়েকটি ঘটনা দেখুন-
১। ১৯৯৯- কিংবা ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের খুতবায় বলা হচ্ছে - জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান কে জাতির পিতা বলা যাবে না ? সাহসও বটে, তবে যুক্তি শূন্য। বয়ানের সময় এক ছাত্রনেতা জিজ্ঞাসা করেন - কায়েদ এ আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বা কামাল আতারতুক - তারাও তো জাতির পিতা বলে তাদের দেশে পরিচিত ? হুজুর আর কথা বলেন না।
২। বয়ানকারি হুজুরদের আমি কাছে পেলেই জানতে চাই— গীতা পড়েছেন, বেদ পড়েছেন? বাইবেল ? ত্রিপিটক ? মহাভারত / রামায়াণ ? পৃথিবীর সকল গ্রন্থ আপনি পড়তে পারবেন না ; তাই বলে কি প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর প্রধান ৩/ ৪ টি গ্রন্থ পড়বেন না? যাদের পড়ার কথা, তারাই( শিক্ষক সমাজ) পড়েন না! হুজুররা আর কি পড়বে ? এভাবেই আমরা তারাপদ রায়ের সেই " আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে" বিখ্যাত কবিতার বাস্তব রূপ দিয়ে গেছি , ক্রমান্বয়ে ? তাই আজ একদল মজে হামলায়, তো অন্য দল দেশছাড়ার গোঙ্গানিতে । স্বদেশ ভূমি ত্যাগের কি নির্মম যন্ত্রণা, সেটা শুনেছি ১৯৭১ এর বাবার অভিজ্ঞতায়, শরণার্থী শিবিরে অভুক্ত মধ্যবিত্ত যুবকের হা হা কার! আর ২০০১ নির্বাচন উত্তর এ পরিবারের সবাই যখন ভারত যাওয়ার পক্ষে, বাবা তখনো 'না ,না' করে গেছে । আত্মীয়দের মধ্যে যারা গেছেন ছিলেন বনেদি, ওখানে আজ তারা অনেকটাই ফকির। ঘর পোড়ার কি নিদারুণ কষ্ট, যারা আলু পোড়া খায় তারা কি জানে, বুঝে সেটা ??
৩। আমরা হুজুরদের বয়ান শুনি, বিজ্ঞান ভিত্তিক কিনা, যুক্তিসম্মত কিনা জানতে চাই না; বরং প্রতিবাদ না করে , এড়িয়ে চলতে গিয়ে আমরা এমন একটি সমাজ এ দাঁড়িয়েছি, এখন বয়ানগুলো ধরে নিয়েছি বিনোদন এর খোরাক [ একাধিক পিএইইচডি গবেষক বলেছেন, পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে yt এ তাদের বয়ান শুনে, হাসি আর ঘুম তাড়াই ] অথচ এগুলো আমাদের চিন্তা, চেতনা আর যুক্তি চর্চার হাতিয়ার হতে পারতো।
৪। আপনি ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কেন আল-কিন্দি, আল ফারাবি পড়বেন না আল-বিরুনি ? কেন এবং কিভাবে মধ্য প্রাচ্যের দর্শন প্রচার করতে গিয়ে ভারতীয় দর্শন এর সমন্বয় ঘটান ; অনুবাদ করেন পতঞ্জলি বা ' ভারত তত্ত্ব' এর মতো মতো বই। আজগুবি তত্ত্ব, তথ্য দিয়ে,রাষ্ট্র শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করাই ধর্ম শক্তির কাজ নয়। আপনাকে পড়তে হবে; এক এবং একমাত্র গ্রন্থ নয় বরং বহুধা বিভক্ত মতবাদের উপর লিখিত গ্রন্থগুলো। যদি আপনি না পড়তে চান, প্রতিবাদ না করেন আপনার শোনা আজগুবি বয়ান, তাহলে ধরে নিতে হবে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে খাপ খাওয়াতে অক্ষম।ধর্ম বিজ্ঞান হতে পারে কিনা বিতর্কের বিষয় কিন্তু একে আপনাকে টেকনিক্যাল বিষয় হিসাবে মানতে হবে ; আর এখানেই সমস্যা শুরু । কারণ নন-টেকনিক্যাল লোকজনরাই টেকনিক্যাল কথা বলে আর সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলে। আর সুবিধা নেয় অন্যজনেরা।
উত্তরণের উপায় কী? রামানুজন মনে করেন — আমাদের এই উপমহাদেশের একটি নিজস্ব পন্থা ও দর্শন আছে, সেঁটা অনুসরণ করতে হবে (Is there an Indian way of thinking, 1989)।সেই সুবাদে কমলকুমার মজুমদারের মতো আমিও আশাবাদী— "ক্রমে আলো আসিতেছে" ( অন্তর্জলি যাত্রা)।

শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২

পিতার পত্র ২১ থেকে -২৪

                                                       



                                                                 পিতার পত্র—২৪ 

প্রিয়পুত্র,

পত্রে শুভেচ্ছা রইল আশা করি ভালো আছ তোমার প্র্রেরিত পত্র পেয়েছি যাহোক  তোমার পরীক্ষা হয়তো শেষ এবং তৃতীয় বর্ষের ১ম ক্লাশ শুরু করেছ তোমার পরীক্ষার ফলাফল শুভ হোকএবং কাংখিত লক্ষ্যে পৌছতে পার ঈশ্বররে কাছে সেটাই প্রার্থনা করি

তোমার অসাধ্য সাধনা পূর্ণ হোক,তুমি কায়মনবাক্যে কৃষ্ণ নাম জপিও  যেন কোনমতেই বিফল না হও

এখন পর্যন্ত লোন হয় নাই এবং ধানের অবস্থা বিশেষ ভাল নয় তাই এবার------------------টাকা দিলাম সামনে আরো দেওয়ার চেষ্টা করছি পত্রের উত্তর দিও

বাড়ীতে সকলেই  মোটামুটি ভাল আছি নূপুর ভাল আছে হয়তো নবান্নে বাড়ী আসবে  তোমার শুভ কামনায় শেষ করছি


ইতি 

তোমারই পিতা

বি:দ্রঈদের ছুটিতে কি ঢাকায় থাকবেকবে ভার্সিটি খুলবে জানাইও

 

 

                                                                পিতার পত্র—২৩ 

 


প্রিয় পুত্র,

পত্রে আর্শীবাদ রইল। আশা করি ভাল আছ। তোমার পত্র পেয়েছি এবং সবকিছু অবগত হলাম । তোমার কাছে টাকা পাঠাবার জন্য চারদিকে ছুটাছুটি করছি এবং সবখানেই অল্পের জন্য বানচাল হয়ে যায়; এদিকে স্কুল বেতনের খবর নাই। 

তাই  তুমি কিভাবে আছ এবং কেমন ভাবছ যার জন্য নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। তবুও আশা ছাড়ি নাই। হাতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে পাঠাবো।

তুমি নির্ভিক –চিত্তে লেখাপড়া কর। স্বীয় লক্ষ্যে তোমাকে পৌছতেই হবে। সেজন্য আর্শীবাদের কৃপনতা নাই, তোমার জন্য এত কিছু ত্যাগ স্বীকার করা

তুমি ভেঙ্গে পড় না, ভয় পেয়োনা,ঈশ্বর হয়তো একটু আড়ালে আছে। 

আমরা ভাল আছি তবে গত ২রা জুন মুজাম মামা  মারা গেছেন। তোমার বিষ্ণুদার জটিল রোগ হয়েছে হয়তো কলকাতায় যাবে। 


সংসার কোনমতে চালাচ্ছি। বাড়ীতে ছোট-বড় সকলেই ভাল। ----------------

তোমার কুশল কামনা করে এখানেই শেষ করছি। 


ইতি 

তোমারই পিতা

 

                                                             পিতার পত্র—২২ 

 

প্র্রিয় পুত্র,

পত্রে আর্শীবাদ রইল। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় ভাল ভাবে পৌছেছ। বদিউজ্জামান আমার সঙ্গে দেখা করে নাই। ভার্সিটির খবর পত্রিকায় পেয়েছি। এবার মাত্র-------------- টাকা পাঠাচ্ছি। বৃষ্টি যেন আর ছাড়েনা, প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সকলেই ভাল আছি। সামনে পরীক্ষার জন্য ভালভাবে প্রস্তুতি নিও। সর্বদাই সজাগ ও সতর্ক থাকিও। 

তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল ও মঙ্গল কামনা করে শেষ করছি। 


 ইতি 

তোমারই পিতা।


বিঃদ্রঃ তুমি ছিলে গৃহ ছিল আনন্দময়/ তুমি নাই , তাই এখন শূন্যময়। 

  নিয়মিত গীতা পাঠ করিও আর ধূমপান করিও না। 

                                                                     

 

পিতার পত্র—২১ 


প্রিয় পুত্র,

শুভাশীষ ও আর্শিবাদ দিয়ে পত্র দিচ্ছি। গত ৮/১১/২০০০ ইং তারিখে তোমার পত্র পেয়ছি। সবকিছু অবগত হলাম। দীর্ঘ সময় পরে তোমার পত্র স্বস্তির আভাস দিয়েছে। যাই হোক হয়তো এ মূহুর্তে ভাল আছ। তোমার লেখাপড়া সর্ম্পকে জানলাম। তবে স্বাস্থ্যে প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিও। আহার বিহার সব কিছু সময়মতো করবে। এবং দুঃশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিও। উত্তেজিত হবে না। ভক্তের অধীন ভগবান । কাজেই প্রথমেই তার ভক্ত হওয়া প্রয়োজন, তাকে লক্ষ্যে রেখে সবকিছু করব। কর্মেই তোমার অধিকার ফলে নয়। 

সময় স্বল্পতা হেতু, এবং বেতন না পাওয়ায় যৎকিষ্ণিৎস্বরুপ --------- টাকা পাঠানো হল। তাছাড়া এবার একটু পাওয়ার টিলার নেয়ার চিন্তা করছি। আগামী পত্রেই এর ফলাফল জানতে পারবে। তবে আগামী ৩০ শে নভেম্বরের মধ্যেই আরো টাকা পাঠাবো। 

তুমি কখনো টাকার চিন্তা করো না। এটা চলবে। সুতারাং তোমার স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য একনিষ্টভাবে কাজ করে যাও। আমার  আর্শিবাদ ও অকুণ্ঠ কামনা রইল । প্রতিদিন তোমার জন্যই ঈশ্বরের  কাছে প্রার্থনা করি "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে - কবি ভরত চন্দ্র ।" 


আমরা বাড়ীতে বর্তমানে ভাল আছি। এবার ফসল ভাল হয় নাই। কারো মুখে হাসি নাই। সকলেই ভাবছে আগামী দিনের কথা। তুচ্ছ মনে করে মন খারাপ করো না। পত্রের উত্তর দিও। তোমার শুভ কামনা করে শেষ করছি। 


      ইতি 

তোমারই পিতা।


বিঃদ্রঃ তোমার বই রায়গঞ্জে পাওয়া যাচ্ছেনা। মালদহে গেলে নিয়ে আসবে। বই পাওয়া যাবে তবে দেরী হবে। 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হেগেল ধর্ম আর ক্রিস্টিয়ান ট্রিনিটি লগে আছে কলোনিয়ালিটি

 হেগেলরে কি লোকজন আইজও পড়েন - ধর্ম আর ক্রিস্টিয়ান ট্রিনিটি লগে আছে কলোনিয়ালিটি 

এটা একটা মুল্যবান প্রশ্ন। আমরা পড়ি । আমাদের পড়াতে হেগেলর মত মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু, পয়েন্ট ব্ল্যাক কেউ না পড়বার চাইলে আমাদের যায় আসে। (আমি জাহিদ ফারাবিয়ান মানুষ, তাই বলে, আমি কি কান্ট বা দেকারতে পড়ব না? আমি ক্রিটিক্যাল স্কুলটাকে জায়নবাদের সাথে মিলাই ফালাই। তাই বলে, হারবারট মারকুজ আর আর্নল্ড কী আমি পড়বনা! হাফিজ হইবার মাঝে দৈন্যতা আছে, বুঝলেন, আনন্দ নাই) হেগেলরে লোকে পড়েন নানান কারণে। আমরা মোটা দাগে কয়েকটা নিয়া কথা কইবার পারি। 

হেগেল খ্রীষ্টানিটির যে ব্যাখ্যা দিয়া গেছেন তা নানা অর্থেই বেশ আগ্রহ জাগায়। খ্রিষ্টানিটি অনেক দার্শনিক, অনেক ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিক তার ফলাফল হিসাবে পশ্চিমের অনেক তত্ত্বের জন্ম হইছে। খ্রীষ্টানিটির ভেতরকার যে সমস্যা-সংকট ও খ্রীষ্টানিটির বিচারের মধ্য থেকে যেসব ভাবের জন্ম, সেগুলোকে সেকুলার চিন্তার ফল হিসেবে ইউনিভার্সাল রূপে হাজির করা হয় প্রায়শই, এবং এই কাজটা হেগেল সাবে খুব ভালা করি করছেন। হেগেল সাবরে পড়ার এইডা অন্যতম একটা কারণ। লন, একটু ব্যাখ্যায় আসি। 

হেগেলের মতে, স্বাধীনতার ধারণা পূর্ণতা পাইছে খ্রিস্টানিটির ভেতরে। মানুষ যে পাপ করেছে, এটা তার স্বাধীনতার স্মারক। সে পাপ করেছে এটা প্রমাণ করে সে স্বাধীন। আবার, পাপ না করার ব্যাপারেও সে স্বাধীন। সে ইচ্ছে করলে ঈশ্বরকে মানতে পারে আবার নাও মানতে পারে। সুতরাং, স্বাধীনতা মানুষের অন্তর্গত স্বভাব। গড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে দু'টো জিনিস লাভ করলোঃ একটা হলো স্বাধীনতা, আরেকটা পাইলো, যুক্তি। যুক্তিপ্রয়োগ মানুষের স্বাধীনতার চূড়ামনি। 

আবার, মানুষের স্বর্গচ্যুতি ও খোদা থেকে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া,হেগেলের মতে, একটি প্রতীকী ব্যাপার। কিসের প্রতীক?" Divide between Individuality and universal reason" এর প্রতীক। গড থেকে আলাদা হয়েই মানুষ ব্যক্তি হয়ে উঠলো। মানুষ যদি আদিতে পাপ করেও থাকে খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আরো অধঃপতিত হয়, তাহলে মানুষের ‘মুক্তির উপায় কি? কিন্তু প্রশ্ন হলো, এক মানুষ তো আরেক মানুষকে মুক্তি দিবার পারবে না। কারণ, প্রতিটি মানুষই সত্তাগতভাবে আদি পাপের অংশীদার৷ তাই, এক মানুষ আরেক মানুষের মুক্তিদাতা হতে পারবে না। কিন্তু যদি এমন কেউ হয় যিনি একই সাথে মানুষের রূপপ্রাপ্ত ও একই সাথে খোদায়ী সত্তার অংশীদার, সে কিন্তু মুক্তিদাতার ভুমিকা পালন করতে পারবে। কারণ, মানুষের পাপীসত্তা আর তার থাকছেনা। আর যেহেতু মুক্তির কারণ হইতে হইবে মানুষের লাগি, তাই মুক্তিদাতাকে একই সাথে মানুষও হতে হবে। তো, এইভাবে "জিসাস"-এর ধারণার ভেতরে মানুষীরূপসম্পন্ন হওয়া ও খোদার পুত্র হওয়া ছাড়া খ্রীষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের সংকট মোচন হতো না। জিসাস তাঁর আত্মহুতির মধ্য দিয়ে মানবসত্তাকে পাপমুক্ত করেন। আর জিসাসের এই আত্মহুতিকে Universal Concept of Freedom এর উদাহরণ মানছেন হেগেল। হেগেল খ্রীষ্টানিটির একটা রেশনালিস্ট ভার্সন এভাবে হাজির করেন। খ্রীষ্টিয় ধর্মতত্ত্বকে তিনি দর্শনের অধীন করেন, এবং খ্রীষ্টিয় নীতিমালাগুলারে চিন্তার ডিটারমিন্ট হিসেবে উপস্থাপন করেন, যেটা দর্শনের অন্যতম কাজ। হেগেলের মতে, রিজনই হইবার পারে ইউনিভার্সাল হইতে। তো, গড হইলো উনার এবসোলিউট রিজন। আর, রাষ্ট্র হইলো Reason Personified" সুতরাং ইনার কাছে  রাষ্ট্রের উদ্ভবের শিকড়টা ধর্মের মাঝেই। অবজেকটিভ রিজনের চূড়ান্ত রূপই রাষ্ট্র। আনুগত্যের প্রশ্ন ছাড়া ধর্ম ও রাষ্ট্র কোনটাই হয়না। এরিস্টটলের অনুসরণে হেগেল কইতেছেন, ব্যক্তি তার পূর্ণবিকাশ ঘটাইবার পারে একমাত্র রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন হলেই। আহেন ডায়ালেকটিক পদ্ধতি দিয়া কি দেখাইলেনঃ

থিসিসঃ  মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে আইনহীন প্রাকৃতিক অবস্থা 

এন্টিথিসিসঃ হায়ারার্কিকাল স্টেটে অতিনিয়ন্ত্রিত অগণতান্ত্রিক ও জাতিরাষ্ট্রে (সিনথেসিস)।

সিনথেসিসঃ গণতান্ত্রিক ও জাতিরাষ্ট্রে

যদিও, হেগেলের কাছে জাতি রাষ্ট্রই ইতিহাসের সমাপ্তি নয়।পরমের পরিকল্পনা নানাভাবেই ইতিহাসে পরিদৃষ্ট হয়। এথেন্সবাসীর কাছে এথেন্সের দুটো অর্থ ছিলঃ এথেন্স রাষ্ট্র হলো, এর প্রতিষ্ঠানসমূহের সমষ্টি, আর এক অর্থ হলো, দেবী এথেনীয় জনগণের জাতি হওয়ার প্রতীক। এভাবে, এথেন্সের রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে প্যাগানিজমের ভূমিকা ছিল। হেগেলের মতে, রাজার আয়নায়, রাজার চেহারা দেখা যায় না, দেখা যায় প্রজার চেহারা। প্রজারা যেমন হয়, রাষ্ট্র ও রাজারা তেমনই হয়। হেগেল কিন্তু ব্লু ব্লাডের কথা মানতেন। তিনি নিজ আছিলেন জার্মানজাত্যাভিমানী ও অরিয়েন্টালিস্টও। যদি আমরা এডওয়ার্ড সাইদরে মনে করি। গ্রীক ও রোমে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণী ছিল স্বাধীন। ইতিহাস পরিক্রমায় একমাত্র খ্রীষ্টানিটির আগমনের ফলেই এই অন্তর্দৃষ্টি জন্মে যে, মানুষ তার মানবসত্তার কারণেই স্বাধীন। ভাবের বা চৈতন্যের স্বাধীনতাই, হেগেলের মতে, মানবসত্তারে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলে। 

মানবজাতি ও খোদার মাঝখানে জিসাস খ্রীষ্টের অবস্থান নির্ধারিত করায় তত্ত্বীয়ভাবে ক্যাথলিক খ্রীষ্টানিটিতে পাপাসি বা পোপতন্ত্রের জন্ম হইছিলো। পোপদেরকে জিসাস ক্রাইস্টের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার মনে করা হয় ৷ সুতরাং, অনুসারীদের আধ্যাত্মিক দেখভালের দায়িত্ব পোপ আর সেইন্টদের। এই পোপতন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ডক্ট্রিন হচ্ছে, "মধ্যস্থতা" বা ইন্টারমিডিয়ারির ধারণা। এই ডক্ট্রিন অনুসারে, ক্ষমালাভের জন্যে যাজকের দ্বারস্থ হইতে হইবে। ব্যক্তি যাজকের মধ্যস্ততা ছাড়া সরাসরি খোদার কাছ থেকে ক্ষমা লাভের যোগ্য হয়না। 

পোপতন্ত্রের আরেকটা দিক হচ্ছে, ইন্ডালজেন্সের (Indulgence)-এর প্রসঙ্গ। অর্থাৎ, কেউ কোন পাপ করে ফেললে সেটির শাস্তি কমানোর ব্যবস্থা। এইটার নানা অপব্যবহার হয়েছে খ্রীস্টধর্মে। Pardoner বলে এক অফিসিয়াল থাকত যে চার্চের ক্ষমা বিক্রি করতো। মানে, চার্চ এমন হয়ে উঠেছিল যে, তারা বেহেস্তের টিকিট বিক্রিও শুরু করে। টাকার বিনিময়ে পাপের ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হতো। সে অর্থগুলো চার্চ তার প্রভাব ও যাজকগণ নিজেদের ভোগ-বিলাসে ব্যয় করতো। হাল আমলের আমাদের দেশে আখিঁ মুন্জিয়া দ্যাখেন – যা চা্ইবেন সবি দ্যাখতে পাবেন বটে!

পোপতন্ত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে, বাইবেলের প্রাথমিকতা ও অগ্রাধিকারের পরিবর্তে চার্চ বা পোপের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হতো। যেটাকে Papal Authority বলে। পোপতন্ত্রে, পোপ বা যাজকদের বা চার্চের অভ্রান্ততা (Infallibility)-তে বিশ্বাস করতে বলা হয়। পোপতন্ত্রে ব্যাখ্যা অনেকটাই নির্বিচার ও যাজকশ্রেণীর স্বার্থলগ্ন হতো। 

কইয়া রাখি অবশ্য, মার্টিন লুথারের যে রিফরমেশন বা সংস্কার আন্দোলন তা ক্যাথলিক চার্চের উপরোক্ত সংকট থেকে জন্ম। প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন নামেও আমরা পড়ি। লুথারের "ডক্ট্রিন অব টু কিংডম" ব'লে একটি ধারণা আছে; যেখানে তিনি কিংডম অব ল এবং কিংডম অব গ্রেস অথবা বলা যায়, ল এবং গোসপেল-এর পার্থক্য করেন। যেটাকে সম্প্রসারিত করে চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ ব'লে অভিহিত করা হয়। হেগেল তার "এইচ-পি’র "The German World" চ্যাপ্টারে খ্রীস্টীয় জগতকে তিন পর্যায়ে ভাগ করেন, Kingdom of Father, Kingdom of Son, Kingdom of Spirit। হেগেল মনে করতেন, সংস্কার আন্দোলনের ফলে জার্মান প্রবেশ করেছে কিংডম অব স্পিরিটে। যে জগতে চিন্তা পায় তার নিজের জীবন ও সংস্কৃতি, যেখানে রাজনৈতিক জীবনের ভিত্তি হইবে র‍্যাশনাল প্রিন্সিপল। হেগেল রাজনৈতিক আলোকায়ন, মানবমুক্তি, যুক্তি ইত্যাদি বিষয়কে খ্রীষ্টানিটির কনসেপ্টের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবেন। অবশ্য পরবর্তীতে কার্ল মার্ক্স হেগেলকে উল্টিয়ে "পায়ের উপর" দাঁড় করানোর কথা বলবেন।

তো, এইভাবে পশ্চিমা সভ্যতার অনেক ধ্যান-ধারণার উৎস খ্রীষ্টান ধর্মের (বিশেষত,সেইন্ট পলের খ্রিস্টানিটি) দার্শনিক বিচার, নানা বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা ও সংস্কার আন্দোলন। পচ্ছিমের যেসব ধারণা বিশ্বময় প্রচার পেয়েছে ও ফেরি করা হচ্ছে তার আদি উৎস রেনেসাঁস, রিফরমেশন, এনলাইটেনমেন্ট-এর দর্শন, তাদের মানুষ সম্পর্কিত ধারণা, পশ্চিমে সংঘঠিত নানা বিদ্রোহ-যুদ্ধ, এবং পশ্চিমের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে নিহিত। জাস্ট, খসড়া আকারে কিছু চিন্তা এখানে টুকে রাখলাম। স্বাধীনতা, যুক্তি, সমতা, মানবিক মর্যাদা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, জাগতিকতা ইত্যাদি নানা গালভরা শব্দ ও ধারণার ইতিহাস আছে, যে ধারণাগুলোকে পশ্চিম সবার জন্যে পালনীয় বুদ্ধির বা চিন্তার নির্ণয় হিসেবে উপস্থাপন করে । এইসব নানা ধারণার ইতিহাস নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।


জাহিদ সিরাজ 

 

শব্দ আর আওয়াজ নিয়া কিছু ওয়াজ

এটাতো হাছাই যে, ভাষা মাইনষের চিন্তা ভবানারে  প্রকাশ করে। ভাষা তো ভাষা না, এটা শব্দ বা আওয়াজ। আমরার কাছে যেটা ভাষা, একজন পরদেশির কাছে তা আওয়াজ ছাড়া আর কী। কিন্তু, এটাই একমাত্র সুন্দর  মাধ্যম। মাইনষের চিন্তা প্রবাহের এই যে প্রকাশ, সেটাই তারে অন্য স্পেসিস থিকা আলাদা করি দিছে।   আমেরিকান লিঙ্গুয়িস্ট নৃবিজ্ঞানী  এডওয়ার্ড স্যাপির মনে করইন, চিন্তা ও ভাষা একে অইন্যের লগে থাকে মানে পরিপূরক। চিন্তা বানায় ভাষারে আবার এই ভাষার বাস্তব রূপটা ধরা দেয় মাইনষের কলমে, বা লেখনীতে অথবা ব্যক্তির কথাবার্তায়। স্যাপির সাবের ভাষায় linguistic determinism!’ আমরা গাও-গেরামে বড় হইছি, আমরার এই বইয়ের শব্দের পেছনের যে চিন্তা, হেইডা সৃষ্টি হইছিলো আমরার যে ভিজুয়ালিটি, সোস্যাল, ফিজিক্যাল ইন্টারএকশনের মাধ্যমে আর  তা হেই ছোট কাল থাইক্যা। ক্রিয়েটিভ ব্রেইন এই ইন্টারএ্যাকশের অভিজ্ঞতাকে চিন্তার প্রসেসের মাধ্যমে আইজকার এই বই। বা বইখানার ভাষাযা ইনক্লুলুসিভ, এবং সেটা চিন্তা প্রকাশের এসথেটিজম।  ভাষা ততক্ষণ এবস্ট্রাকড থাকে যতক্ষণ না তা আমরা সেটারে প্রকাশ করি লেখায়। তাই, আমরা যদি শক্তিশালী জারগন টারগন আর হাই ভোল্টেজ শব্দের মাইর প্যাঁচ দিয়া লিখতাম, আফনেরা কইতেন, খাইছে, পড়া বা হুনার দরকার নাই। কারণ, আমরার চিন্তা জগত জারগন মার্কা শব্দের লগে পরিচিত না। তাই আমরা কইতেছি এমন এক আওয়াজেযাতে লেখাও হইলো আর আফনেরার কানে খঞ্জনির মতো ক্লিয়ার হুনাইবো।  একই লগে, চউখে দেখাইব যা দেখবার চাইন- Visual spell! 

এই বইয়ে আমরা শব্দগুলা এমন কইরা বানাইছি। আফনেরার মনে হইবো  আমরা স্বেচ্ছাচারী হই গেছি। মোটেই তা না জনাব।  শব্দের শুদ্ধতা’ আর আফনেরার বিদ্যাপতিদের বড় বড় পিউরিটি’ আমরা ভাঙলাম। এই মিউজিক্যাল ভিজুয়াল ল্যাংগুয়েজ বুঝতে যেন কষ্ট নায়। ব্যবহার করছি এক্কেবারে মাঠ আর মাটির মানুষের কথ্য শব্দ। এমন শব্দগুলা বাক্যে হাজির হয় যেন আফনের রাধারমনের মিউজিকের মুভমেন্ট অনুভব করবার পারইন। বাক্যগুলার শব্দ সাজাইছি  আওয়াজটার দিকে চউখ রাখি’ রাখি। আর তাই, পাঠক হিসেবে পড়লে দেখবেন কানের  মাঝে শব্দগুলো লাইগ্যা থাকবো। আফনের মনের ভাঙাগড়াটারে এক ডিভাইন আবরণ দিয়া তৈয়ার করবার পারেন। 

ভারত থাকি গ্রীক হইয়া আরব, তারপরে পশ্চিম। লিংকটা জানার দরকার আছে, যদি দর্শন নিয়া একটু  আফনেরার করোর আগ্রহ থাকে।  আমাদের ধারণায় যা আইছে তাই কইলাম এতক্ষণ। এগুলারে আপনি মানতে পারেন, নাও মানতে পারেন। কিন্তু, আপনার মানা বা না মানাটাকে ইতিহাস দিয়ে দেখুন। কারো কইয়া রাখা দাবিরে ‘সত্য’ বইলা মানার আগে বরং কইমু নিজের ইনফারেন্স বা দৈবাদেশ দিয়া ভাবেন, তাইলে, বুঝবেন, আপনার সত্যটা আমার কাছে সত্য নাও হইবার পারে। 

আমাদের এই এন্ট্রি হক্কল বিষয় নিয়া আলোচনা করতো না, তবে অনেক প্রশ্ন জিগাইয়া রাখলো। আফনে একলা বইয়া একটু চিন্তা করবেন, এইডা আমদের ইচ্ছা। যে প্রশ্নগুলা মাথায় আইবো,  তা নিয়া চিন্তা করবার লাগি আপনার অডিটরি অর্গানগুলা দিঘীর পানির লাহান স্থির থাকবো। এই আলাপ আলোচনারে আইল দিয়া বান্ধিতে হইছে, সীমানা টানা থাকলে ভালা। আমরার কাছে সকলেই সমান। প্রফেসর রাজ্জাক একবার আহমদ ছফারে কইছিলেন, শেক্সপিয়ার তাঁর ইহুদি শাইলকরে, ইহুদিগো লাল-রক্ত আছে। ইহুদি শাইলকের এই কথাগুলার লগে বারনারড লুইসের কথার মিল আছে বিস্তর (নোট ৬৯ দেখেন)। শাইলকের পুরা বক্তব্যটাও দিলাম।[i] ভাবতে পারেন! কলোনির কইলজার  মইধ্যে থাইক্কা, ১৬০০ সনে এমন কথা কইতে পারছিলেন! 

আমরা এই টোটালিটিটাকে বুঝবার চেষ্টা করতেছি। লাল-নীল রক্ত আর পুব-পচ্ছিমের মাইর আমরা চাইনা। কান্ট আর আল-ফারবি বা সাদিয়া গাঁও বা তাঁর সমকালেই আরেক ইহুদী পলিম্যাথ মাইমুন্দাস, আল-কিন্দি লইয়া বহেন। কান্ট'র কয়েকশ’ জন্ম আগে ক্রিটিক্যাল কথাটা সাদিয়া গাঁও কি সুন্দর করি’ বলে দিছেন, জ্ঞানের থিওরি। জানি, আল-ফারাবি মুসলিম, সাদিয়া গাও আর মাইমুন্দাসরা ইহুদি, চৈতন্য আর লালন পুবের মানুষ, সুতরাং তিনাদের আমরা পড়তে যামু কোন দুঃখে! তিনারা আমাদের পশ্চিমের আকাশে ব্রাত্য, তিনারা পুবের বলেই তিনারা অচ্ছুৎ। আমরা এটাও জানি আমরা পুবের মানুষ, আমরা জাগলে পৃথিবী জাগে। সাহস করি’ আরেকটা কথা কই, জন্মটা কখনোই আজন্ম পাপ হয়না, হইবার পারেনা। 



[i] I am a Jew. Hath not a Jew eyes? Hath not a Jew hands, organs, dimensions, senses, affections, passions; fed with the same food, hurt with the same weapons, subject to the same diseases, healed by the same means, warmed and cooled by the same winter and summer as a Christian is? If you prick us do we not bleed? If you tickle us do we not laugh? If you poison us do we not die? And if you wrong us shall we not revenge? If we are like you in the rest, we will resemble you in that. If a Jew wrong a Christian, what is his humility? Revenge. If a Christian wrong a Jew, what should his sufferance be by Christian example? Why, revenge. The villainy you teach me I will execute, and it shall go hard but I will better the instruction.