এই ব্লগটি সন্ধান করুন

বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পরকীয়া: পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের শিকার নারীর শরীর

 আমরা যারা পুরুষনারীর কাছে শতভাগ বিশুদ্ধতা কিংবা সততা চাই তারা নিজে কতোটা শুদ্ধ অথবা পরিশুদ্ধকার মানদন্ডে সঠিক তা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তুলিনা। যদি কেউ এতদসংক্রান্ত প্রশ্ন তুলে তাহলে বিষয়টিকে কেবল নারীর জন্য সযত্নে আগলে রাখি। শব্দের গাঁথুনী কিংবা বাক্যবানে অথবা যুক্তির বেড়াজালে নারীকে করি তুলি অপাঙ্তেয়। নারী পবিত্র বা অপবিত্র যাই হোক নাআলোচনা বিষয়বস্তুনারীর শরীর ও তার ব্যবহারের মনস্তাত্তিক প্রেক্ষাপটের নীতিদীর্ঘ রচনা লেখা।

কৃষির সূচনা নারীর হাতে তাহলে বলা যেতেই পারেঅর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত্তি নারী। কিন্তু নারী তার দৃঢতায় পথ চলতে পারেনি। বারবার পথচ্যুত হয়েছেহারিয়েছে তার সততা ও বিশুদ্ধতার উপাধিটি। প্রখ্যাত মার্ক্সসিস্ট ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস পরিবারের বিবর্তনের যে ধারাটি দেখিয়েছেন সেখানে নারীর যৌন স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি স্পষ্টতঃ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাই তো যৌনবৃত্তিতে নারীর কলঙ্ক তিলক থাকলেও পুরুষ পরিচয় দেয় এটাই পৌরুষত্ব কিংবা শৌর্ষ-বীর্যের লক্ষণ হিসেবে। রেবতী বর্মন বলুন কিংবা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসই বলুনঅর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিলোপই নারীকে টেনেছে পিছনে। এ বিষয়ে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই।

মার্কসীয় ধারায় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের আড়ালে উদারনৈতিকতার নামে যৌনবৃত্তির বৈধতা দিলেও সমাজ-সংস্কার একে বৈধতা না দিয়ে বরং টেনেছে আরো পিছনে। উত্তরোত্তর প্রযুক্তির বিকাশে নারীর শরীর বরাবরই লক্ষ্যবস্তু। তাই ইস্টার বশেরাফেরনারী ক্ষমতায়নঅর্থনৈতিক উন্নয়ন নারীর শরীর থেকে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী সরাতে তো পারেনি বরং দৃষ্টি দিয়েছে আরো সতর্কভাবে। পুরুষ নারীকে পেতে চায় বিভিন্ন উপায়ে এমনকি ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্বে হলেও।

পরকীয়া এমনই একটি সামাজিক প্রপঞ্চ যা নারীকে বিবেচনা করে ভোগ্য পণ্য হিসেবে। এই ভোগ্য পণ্যের সরব উপস্থিতি আমরা হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদেও পাই এভাবে- “যে বঁধুটি দিনের বেলায় কাকের শব্দে ভয় পায়। সেই বঁধুটিই আবার রাতের বেলায় অভিসারে যায়।” চর্যাপদের কবি ঢেগুনপার কবিতায় পাওয়া যায়- “টলেত মোর ঘোর নাহি পড়াবেষী হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।” অর্থ্যাৎঘরে ভাত না থাকলেও প্রেমিক এসে ঘরে ভিড় করে। আহাকী শান্তি পরকীয়ায়অন্যের দখলে থাকা ভূমিতে চাষাবাদ করো ইচ্ছেমতো?

নারীর অঙ্গ বর্ণনা বাংলা গানের বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। কবিতায় উপন্যাসেগীতি নাট্যপ্রবন্ধমহাকাব্যে। নারীর অঙ্গ বর্ণনায়হাজারো শব্দের সমাহার। কিন্তু গানে পরকীয়ার সন্ধান বিশেষ অঙ্গের বিশেষ ব্যবহার পাওয়া যায় এভাবে- “ভ্রমর কইও গিয়াশ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমরকইও গিয়া।” ভ্রমরের দূতিয়ালিতে রাধার ব্যাকুলতা নিরসনে কৃষ্ণের উপস্থিতি পরকীয়া প্রেমের উদাহরণে এই বিশেষ অঙ্গের কি যে জ্বলুনি তা সহসাই অনুমেয়। কিংবা ঐ শুনো কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কেরে সখীবংশী বাজায় কেএখানেও পরকীয়া প্রেমের সরস উপস্থিতি পাওয়া যায়। রাধা যখন সখীর সনে জল ভরতে নদীতে যায় তখন কৃষ্ণ বাঁশী বাজায়ে চায় রাধাকে আকৃষ্ট করতে। রাধা বিবাহিত বলে কলঙ্কের ভাগ তাকেই নিতে হয়। যেমনটা বলা হয়েছে এ লেখার শুরুতে।

গানে আমরা আরো পাই যেযখন শুনি- “চল বিয়াইন আজ মন কুড়াতে যাই” শীর্ষক বাংলার লোক সঙ্গীতে (বিয়াইন সর্ম্পকটিকে বিবেচনা করুনযখন বিয়াইনকে মন কুড়ানোর প্রস্তাব দেয়াতখন স্পষ্টতই পরকীয়া প্রেমের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কিংবা আমরা পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের গানের সুরে বলতে পারি যে, ”আমায় এতো রাতে কেনে ডাক দিলাপ্রাণ কোকিলা রেশিয়রে শ্বাশুড়ী ঘুমায়জ্বলন্ত ডাকিনীপইঠানে ননদী শুয়ে দুরন্ত নাগিনী।” পুরো গানটি শুনলে ধ্রুপদী বাংলার চিত্র পাওয়ার পাশাপাশি আপনি প্রেমের চিরন্তন পরকীয়ার রসায়নটি পাবেন। তখন মনে হবে কোজাগরি জ্যোসনায় আপনি শরৎ চন্দ্রের দেবদাস হয়ে কেরু এন্ড কোং এর পানীয় হাতে কাজী নজরুল ইসলামপূজারিণী কবিতার ‘‘নারীএরা লোভীএরা দেবীএরা একা কারো নাহি হতে চায়যত পূজা পায়চায় তত আরো” বারবার আবৃত্তি করবেন। অর্থ্যাৎ নারীর প্রেমকে দেখা হয়েছে অবজ্ঞাভরে। অথচ একই কাজে পুরুষকে দেখা হয় সুপুরুষ হিসেবে। যার কারণে বলা যায় প্রেম শব্দটি উভয় লিঙ্গের কাছে কোন ভাবেই একই অর্থ বোঝায় না।

কোন মন্তব্য নেই: