কেন্দ্রহীন বৃত্ত,
কোন ভাবেই মিলাতে পারছিল না সে। সে কে? আর এ হিসাব কী? তারই কথা বলার জন্য আজকের আয়োজন। জীবন যেন সত্যিই আঁকা বাঁকা রাস্তা, যেন বন্ধুর পথ, কতক দীর্ঘশ্বাসের সমষ্টি এমনি নানা জল্পনা-কল্পনা। মায়ের কোল সন্তানের নির্ভীক আশ্রয়। সেই আশ্রয়ও নেই। অনেক আগেই এক অকাল শারদীয় ঝড়ে সেই কাঙ্খিত আশ্রয় ভেস্তে গেছে। যা এখন কেবল স্মৃতি-ঝাপসা কল্পনা, নাসারন্ধ্রের দুটি ছিদ্র দিয়ে তপ্ত বায়ু বের হয় যাকে বলে দীর্ঘশ্বাস। আর তাই কেবল কলমকে সঙ্গী করে নিয়েছে সে। কলমের মাঝে খুঁজে নেয় তার মাকে, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত গুলোর হিসাব নিকাশ। কিন্তু কিছুতেই মিলাতে পারছেনা সে। সে এক ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। ভাগ্যের নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতা যেন পদে পদে শৃঙ্খলা পরিয়ে রেখেছে। এই শৃঙ্খল চিরশ্বাশত, অবিনাশী গান গায়। এই শৃঙ্খলকে ছেড়া যায় না। চাবি দিয়ে খোলা যায়না, লোহার শক্ত হাতুড়ি দিয়ে পিটালে, শিকলের প্যাঁচ আরো প্রশস্ত হয়। সে এক অনতিক্রম এবং দুর্দমনীয় শিকল। দুঃখবোধ আর অভাব বোধ থেকে যে অভাবের সৃষ্টি। তাকে ধ্বংস করতে হলে যে সুখ আর ঐশ্বর্যের প্রয়োজন। কিন্তু সেসব আসবে কোথেকে? প্রশ্নটা রয়েই যায়? বুকের মধ্যে যেখানে সব স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খার অপমৃত্যু ঘটেছে এবং বেদনার ধূলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তখন ইচ্ছে করে, খুব ইচ্ছে করে সব কিছু ধ্বংসের জন্য ধ্বংস যজ্ঞ করে ফেলি। পৃথিবী এক অসাড় ক্ষেত্র যেখানে মরলেও কোন শান্তি নেই, বেঁচে থাকলেও কোন লাভ নেই,তাই ধ্বংস যজ্ঞের শাস্তি পাওয়া তার একমাত্র প্রায়শ্চিত। সে অর্থাৎ এ গল্পের নায়ক এমন নানা ভাবনায় ডুব মেরেছে।ট্রেন ছুটে চলছে। ঝক ঝক শব্দে বিরামহীন ভাবে ‘তিস্তা’ এক্সপ্রেস ছুটে চলছে। সীটে বসে বসে কেবল জীবনের মহা অংকটি কষছে। মনে পড়ে যায়-ছোট্ট কালের কথা। মা সবাইকে ভাত খাওয়ায়। সে কাঁদে, এ কান্না বিরহের, সংসারের অভাবের। খাদ্যের অভাব। তথাপি সে সুখী। মা মাথায় হাত দিয়ে কতবার বলেছে জীবনে বড় হও, তখন না হয় তিন বেলায় পেট ভরে খাবো। গল্পগুজবে কেবল ভাত হজম করব। এখন কষ্ট করছি, তুমি সুখ এনে দিবে, ব্যবসা-চাকুরি করবে, আর আমি মা হয়ে কেবল নিরন্তর প্রেরণা দিব। এমন চাওয়া প্রত্যেক মায়ের। কিন্তু! কিন্তু কী! মায়ের এমন চাওয়ায় যদি সন্তান পূরণে সক্ষমতা অর্জন করে আর তা হবে দুঃখজনক যদি, ‘মা’ বেঁচে না থাকে। নায়কের এ দুঃখ পাঠক নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছেন? তাই কষ্টের বিষয়- সেই মা কথা রাখে নি। শারদীয় ঝড়ে উড়ে গেছে সেই আশাবাদী মা! দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেছেন তার দুঃখবাদী সন্তানদেরকে। কেউ কোন এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায় না সমাজ তাকে বাধ্য করে দুঃখবাদী, ভাববাদী ইত্যাদি বাদী নামক পদবী ব্যবহারে। এভাবে ভাবছে সে, তার ভাবনা যেমন দ্রুত, তেমনি ট্রেনের গতিও দ্রুত। লোহা সোজা কিন্তু লাইন বাঁকা। কেন? উত্তর জানিনা। ট্রেন যখন আঁকা বাঁকা লাইনে ছুটছে তখন তার উপরে থাকা যাত্রীর ভাবনাই বা সোজা চলবে কেন? কল্পনাগুলো যেন সব জবু থবু হয়ে গেছে। সে অতীত দিনে ফিরে যেতে চাইলো। ব্যাগ থেকে বই বের করতে গিয়ে ডায়েরীটা উঠে আসলো হাতে। যেন গভীর নিঃস্তব্দতা। হাতখানি কেঁপে উঠলো। ব্যাগে কয়েকটা বই, গোটা ডজন খানেক নোট খাতা, ডায়েরীটা আর জামা প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কাছে এ ব্যাগে আরো কিছু থাকার কথা ছিল- মায়ের হাতের মোয়া, নাড়ু, মুড়ি, আম, লিচু থোকা, নারিকেলের নাড়ু, কিংবা খোসা ছাড়ানো নারিকেল। কারণ সামার ভ্যাকেশন শেষে সে বাড়ী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। তার রুমমেটরাও এমনি অনেক জিনিস নিয়ে আসে, সবাই নিয়ে আসে, কেবল বাকী থাকে সে। ব্যথা বেদনার মূর্ত প্রতীক সে। তার রুমমেটরাও এতে সমব্যথী হয় আর দুঃখটা বাড়ে তারই বেশী। ব্যাগ থেকে যখন ফল-মূল, বেরোলোনা, বেরোলো একটা গল্পের বই, বেরেলো একটা ডায়েরী, দিলো ক্ষতে আঘাত, যার যেটা দুর্বল জায়গা সেই দুর্বল জায়গায় সবাই বেশী বেশী করে আঘাত করে, আর তাতে আঘাত করার সাধটাই যেন আলাদা, ঠিক অমৃতের মতো। নইলে ঘটে কেন? তাইতো এমন হয়। একজন আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে আর অন্যজন মজা লুটবে; বাহ্ কি চমৎকার! জোনাথন সুইফটের একটা উক্তিকে আওড়াতে চাইল কিন্তু মনে আসলো না। সে সৎসাহস করে ডায়েরীটা তুলে নিলো, মনে পড়ে গেলো শিশুকালে সমস্বরে ‘শিশুশিক্ষা’ বইয়ে পড়তাম ‘দুঃশীলের ক্ষয়, দুঃসাহসে দুঃখ হয়।’এর অর্থ বুঝতাম না। স্যার কেবল বলত ‘মুখস্ত কর, আমি কন্ঠস্থ, ঠোঁঠস্থ চাই। তাই, পড়েই চলছিলাম। আর এখন তার মর্মার্থ, ভাবার্থ দুনিয়ার যত অর্থ সবই বোধগম্য। কিন্তু করার কিছুই নেই। যে ডায়েরীটাকে সে লিখে লিখে ভরিয়ে দিয়েছে । আবার তাকেই কেন ভয় করছে সে? যার জন্ম ও মৃত্যু তারই হাতে, তথাপি ভয় হয়। যে বাবা মা কত কষ্ট করে সন্তান জন্মায়, লালন পালন করে আবার সেই সন্তান বাবা-মায়ের বুকে পাথর নিক্ষেপ করে রক্ত ঝরায় অথচ বাবা মা….। এমন এক অসহায় অবস্থা আমার ও ডায়েরীর মাঝে। মনের অজান্তেই সে বলে উঠলো দুঃখ দিয়ে যাদের জীবন গড়া, দুঃখ কে তাদের দুঃখ বলা সাজেনা। বরং নিরর্থক বোকামীটাই প্রকাশ পায়। এই ভেবে সে ডায়েরীটা নাড়া-চড়া করে,স্মৃতির জলে স্নান করে। যে স্নানে মন ও শরীরে ব্যাথার আগুন ধরে যায়। তাই সে ওটা পড়তে চায়না। এখানে লিপিব্ধ আছে একটি গল্প, একটি অভিসারের পূর্ণ কাহিনী। চিত্রা একটি মেয়ে। চিত্রা একটি গল্প, চিত্রা একটি বিরহ অধ্যায়। ব্যথাভরা কাব্য। যে কাব্যের কাব্যমূল্য, গল্পের সূচনা কিংবা সার্থকতা চিত্রার কাছে নেই। কিন্তু সে সব খুঁজে পায়।কারন সে খুঁজে নেয়। যে নেয় সেই কেবল পায়। অন্য কারণ সে কাব্যে খুঁজে পায় আবেগ ঘন ভাষা,শব্দ চয়নের দক্ষতা, বাস্তবধর্মী ও চমৎকারিত্ব শুরু ও সমাপ্তি এবং কল্পনার ঘনঘটা সে কাব্যে লিখেছে———–
“আমার কবিতায় থাকতে চেয়ে তুমি
হলে অন্যের গল্পের নায়িকা,
আমার বাঁশরীর সুর হতে চেয়ে
অন্যের কন্ঠে পেলে শোভা।
কথা দিয়ে তুমি রাখলেনা কথা
আধো চেনার গলায় দিলে মালা,
তোমার আমার মাঝে সাঁকো
বাঁধবে বলে দিলে আশ্বাস
তা, না করে নদী করে দিলে ভেঙ্গে তুমি দিলে, দেওয়া তোমার বিশ্বাস!”
নিন্দুকেরা কিছু বলে না। কিন্তু চিত্রা বলেছে। সেতো অনেক কিছুই বলেছে। গল্পের সার্থকতা চিত্রা খুঁজে পায়নি। খুঁজে পেয়েছে কিছু ব্যর্থতা! যে অর্থ ছাড়া কিছুই বুঝেনা। তাকে ব্যর্থতা তাড়া করবেই, এটাই স্বাভাবিক। সে কবিতায় প্রশ্ন রেখেছে চিত্রার কাছে-
“তুমি কি আমায় আগের মতো ভালো বাসোনা?
কোন স্বপ্নীল আবেশে কাছে টানোনা।
রচনা কি করোনা কোন কল্পিত স্বর্গ বাস?”
চিত্রার কোন সদুত্তোর নেই। হঠাৎ করে শুরু আর শেষটাও বড্ড আকস্মিক। মাঝে কেবল মান অভিমানের পালা তারপর দু’জনে দু’মেরুর বাসিন্দা। বসবাস যেন দু’টি ভিন্ন গ্রহে। একটি বিরাট কাহিনীর একটি অংশ। এ গল্পটি, তাই জীবনের একটা অধ্যায় হিসাবে মেনে নিয়েছে সে। সেই চিত্রার সঙ্গে বেশ কয়েক বছর হলো দেখা হয়নি। তার পূর্বে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরও সে জিজ্ঞেস করেনি-‘ কেমন আছো। ধরেই নিয়েছে সে ভালো আছে কিংবা নেই। ‘গভীর প্রেম কাছে টানে না দূরেও ঠেলে দেয়।’ এরই নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার সে। আষাঢ়ের কোন এক মিষ্টি বিকালে চিত্রাকে ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। তার আগে এক ঝাঁক বৃষ্টি হয়েছে, আকাশ পরিস্কার, শাদা-কালো মেঘের সমাহার ঘটলেও আকাশ মূলতঃ মেঘ মুক্ত। বৈকালিক রোদে আকাশ ভেসে যাচ্ছিল আলোর বন্যায়, ফুরফুরে হাওয়া সব কিছুতেই যেন সজীবতা, প্রাণচঞ্চলতা। কারণ একটি সতেরো বছর বয়সের ছেলে একটি ষোড়শীকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে কী লিখেছে প্রকৃতি যেন জানার জন্য ব্যাকুল। এ চিঠি ভালোলাগার, ভালোবাসার চিঠি; তাই সবাই খুশী। মেয়েটি যখন চিঠির কথা আকাশকে বাতাসকে জানাল না; জানাল না প্রকৃতির কাউকে তখন আকাশ কাঁদতে শুরু করে দিলো। সে কী কান্না। যেন থামতেই চায়না। গাল, ঠোঁট ফুরিয়ে কেবল কাঁদছে আর কাঁদছে। বাতাস অভিশাপ দিলো এ চিঠির খবর সবাইকে বলে দিবো। তাই এ খুশী বেশীক্ষণ রইল না। আকাশ আর বাতাসের জ্বালাতনে সবুজ সংকেতে তার মা ঘরে ঢুকেই নজর পড়ল চিঠিটার উপর। চিঠিটা নিল তার মা। ফলে যা হবার হাই হয়ে যায়। পত্রে, পত্র লেখকের কোন পরিচয় ছিলনা। লেখক বেঁচে যায় কোন মতে। যত ঝড় ঝঞ্ঝা পত্র প্রাপকের কপালেই। কারণ সেতো প্রাপক। তবুও লেখা থামেনি। তার বাবার লাল সংকেত দমাতে পারেনি দু’জন কেই। প্রাপকের ভূমিকা বরাবরই চিত্রা পালন করেছে। ব্যতিক্রম ঘটেছে নগন্য ভাবে। এভাবেই ভাবটা জমাল সে। চিত্রা স্কুল পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হল। সব কিছুই যেন তার পাল্টে গেল। এমনকি প্রেমিক পাল্টাতেও সে ভুল করলোনা। নারীকে তাই বিবর্তনের চেয়ে পরিবর্তনই বেশ মানায়। চিত্রা, নজরুলের নিম্নের লাইন ক’টিকে বেশ সমর্থন করল। সে জানে না নজরুলের এ অভিজ্ঞতা লব্ধ ফসল নাকি বাস্তবতার পরিহাস। নজরুলের পূজারিনী কবিতায় কবি বলেছেন-
“ নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয় এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহুজন।
যে পূজা পুজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে!”
চিত্রা তার নতুন প্রেমিককে অথবা বন্ধুকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে লাগলো। সে ভাবলো মানুষ কেন এত বৈচিত্র্যতার অধিকারী! ব্যবহারে কেন বৈচিত্র্যময়তা? সত্যিই মানুষ এক আশ্চর্য জনকবস্তু বটে! জোনাথন সুইফটের বাণীটি মনে পড়েছে তার। তিনি বলেছেন-“ আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি মানুষ নামক প্রাণীটিকে।” সে চিত্রাকে ধরেই নিলো একটি চরিত্রহীন মেয়ে, যার চরিত্রের কোন কুল কিনারা নেই। তাছাড়া চিত্রা শহরের কলেজে পড়ে আর সে তার কাছ থেকে হাজার মাইলের ব্যবধানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। যুক্তি সঙ্গত কারেণই সে চিত্রার আদ্যোপান্ত হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি। বিশ্বাসের উপর যে সম্পর্ক তাতে স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ ঢুকলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। অথচ সে, চিত্রাকে খুব ভালোবাসতো, তার ধ্যানে নয়, মনেও ছিল সে। চিত্রার অপূর্ণ হৃদয় পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করেছে বারবার। কিন্তু যার পূর্ণ-অপূর্ণ সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই তার হৃদয় পূর্ণ হয় কী করে? সে চিত্রাকে মনে করত নদীর ঢেউ, যে ঢেউ সর্বক্ষণ নদীর উপর জুড়িয়ে থাকে। নদীও ঢেউ যেন পরিপূরক। এ রকম একটি জুটি সেও চিত্রা। কেন এমন ব্যবচ্ছেদ ঘটলো। কিসে তার হৃদয় পূর্ণ হতো? এমন ভাবনার মাঝে সে হিসাব মিলাতে লাগলো তার জীবনের। বারবার ভুল করতে লাগলো সে। এবারও ভুল হলো। হিসাব মিলল না। এসব স্মৃতি আর ট্রেনের গতি যেন সমভাবে সমতালে ছুটে চলছে। ডায়েরী বন্ধ করে হাত দিয়ে কোলের উপর চেপে ধরে সে। ট্রেনের জানালায় উঁকি মেরে চোখ বুলায় বাংলার বুকে, দেখে বাংলার মুখ। তন্ন তন্ন করে খুঁজে জীবনানন্দের রুপসী বাংলা, বনলতা সেনের মুখ, মায়াবী চোখ, রবীঠাকুরের সোনার বাংলা, সোনার ফসল, সেই রুপ, মুখ, চোখ বাংলা কিছুই নেই। চারদিকে কেবল হতাশার নিঃশ্বাস শকুনের আঘাতে জীর্ণ-শীর্ণ যেন চেহারা, ম্লান করে দিয়েছে চেহারার উজ্জ্বলতাটুকু। নিত্য নতুন অভাব, দারিদ্রতা, রোগ-শোক যেন সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছে। সর্বত্রই শকুনের দৃষ্টি, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রতিযোগিতা, স্বার্থ-নিঃস্বার্থ দ্বন্ধ, নৈতিকতার পতন, নৈরাজ্য, হতাশার উত্থান, আমার আর আমি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সবাই এমন পরিস্থিতিতে কোন মতে বেঁচে থাকায় দায়। শান্তিদেবী তো অনেক কালেই মহানিদ্রায় শায়িত। কোনদিন তার নিদ্রা ভাঙ্গবে কিনা সেটা নির্ভর করছে অশান্তি দেবীর উপর। এরকম সমাজের নানা চিন্তায় যেন ব্যথা বেদনার মূর্ত প্রতীক সে। মনের ক্ষত গুলো যেন দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ক্ষতগুলো যেন কিছুতেই ভর্তি হয়না, যতই ব্যথা বেদনা, দুঃখ কষ্ট, যন্ত্রণা, ভাঙ্গা স্বপ্ন ঢালা হচ্ছে তথাপি সে যেন অপূর্ণ থেকেই যাচ্ছে, চিত্রার হৃদয়ের মতো। এই মূহুর্তে পৃথিবীর সব ভাবনাকে সে এখন ভাবছে। এত কিছু করার পর, ভাবার পর বিরক্ত হয়ে আর ডায়েরীটা খুলল সে। ডায়েরীটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সোজা চলে চিত্রাকে লেখা শেষ চিঠির কথায়। চিত্রার প্রেম কাহিনী যখন ফুলদমে চলছে তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে। সে একদিন লিখে জানাল ‘চিত্রা’ তোমার নোংরামী আর নষ্টামী আমাকে ব্যথিত করে, দুঃখ দেয়। গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছাচারতন্ত্র চালু করে সুখ তুমি পাবেনা। এখন, তোমাকে যতটা ভালবাসতাম ঘৃণা করি তার চেয়ে বেশী। ’ চিত্রার নতুন প্রেমিক একজন চাকুরীজিবী। আর সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্বভাবতই চিত্রা স্বার্থের কারণে জলাঞ্জলি দিল তার প্রেম-ভালোবাসাকে। দেখতে লাগলো স্বপ্ন, বুনতে শুরু করল কল্পনা-কৌশলের জাল, সাজতে লাগলো বউ, বাসরও হয়ে গেল কয়েক মাসের মধ্যে। সে তখন পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। তাই তাকে নিয়ে ভাববার ফুরসত পায়নি সে। জোনাথন সুইফটের ভাষায়-“ এই ঘৃণিত জন্তুটা” যে আজকের গল্পের নায়িকা হবে, এটা ভাবলেই অবাক হয়ে যায় সে, থমকে দাঁড়ায় চলার পথে, ক্ষতবিক্ষত হয় বিবেক! ট্রেন ঠিক স্টেশনে থেমে গেছে। কল্পনা আর ভাবনার জলে অবগাহন করতে করতে সে বড্ড ক্লান্ত।চিত্রাকে ঘৃণা করা ছাড়া অন্যকোন উপায় ছিলনা। এটাই ছিল নীরব প্রতিবাদ। সে অতীতকে ভুলে গেছে। এটা এক রকম ভুলে যেতে বাধ্য হওয়া। মাঝে মাঝে স্মৃতি গুলো মনের জানালায় টোকা দেয় তখন সে হাসিতে ফেটে পড়ে। অফিসের অন্যরা প্রশ্ন করতে সাহস পায়না। তারাও সুর মেলায়। তারা ভাবে স্যার হয়তো খোশ মেজাজেই আছে। হঠাৎ এক বন্ধু চিঠি লিখে জানাল চিত্রা সুখে নেই নিরন্তর দুঃখ বহে যাচ্ছে জীবনের উপর দিয়ে। সাহস আর অদম্য হারিয়ে এখন ঝরে পড়া ফুল, যে ফুলে নেই কোন গন্ধ শুধু বেঁচে থাকার লড়াই মাত্র। সে চমকালো। চিত্রাকে সে ঘৃণা করে কিন্তু চিত্রার দুঃখ কষ্ট চায়না। চায় চিত্রা সুখে থাকুক। এ কামনা সে সারা জীবন করে থাকে। ঈশ্বরের কাছে প্রতিনিয়ত কামনা করে চিত্রাকে সুখে রাখো তুমি। যে কাউকে ঘৃণা করা আর তার অমঙ্গল, দুঃখ কামনা করা নিশ্চয় এক নয়? অনেক কাল পেরিয়ে, ঝড় ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে জীবনের সিঁড়ি সে খুঁজে পেয়েছে। সে এখন সরকারী কর্মকর্তা। পুলিশের উর্দ্ধতন অফিসার। তার দিন সুখেই যাচ্ছিল। চাকুরী জীবন আর ব্যক্তিগত জীবন মিলিয়ে সে এখন সুখী। গ্রামের বাড়ীতে বাবা আর ভাই। আরেক ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের মাঝেই খুঁজে পায় মায়ের মমতা, জীবনের অর্থ। সাহস আর উদ্যমে বেশ ভালোয় কাটছিল তার জীবন। চলার পথে চিত্রার দুঃখ তাকে কষ্ট দিল। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে এটা সে ভাবতে পারেনি। সব কি দৈবের ঘটনা? নাকি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কিংবা জন্ম, জন্মান্তরের পাপের ফসল? লজিকের ভাষায়- এটাই ফলস অব্ ফ্যালাসি বা কাকতালীয় ঘটনা। চিত্রার স্বামী পুলিশের কষ্টেবলের পদ থেকে আজ পদোন্নতি পেয়ে এস. আই। কিন্তু মুখো-মুখী হয়ে বিব্রত কর অবস্থায় পড়ল সে। কেমন যেন অস্থিরতা চেপে বসল দু’ঘাড়ে। বের হতে লাগল দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস। এ শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট আছে, বেদনার অনুভূতি আছে। আছে এক মমত্ববোধের ছোঁয়া। বাসায় কেউ নেই। কেবল সে একাই থাকে। রান্না-বান্না করে দেওয়ার লোকেরা সময় মতো আসে আবার সময় মতো চলে যায়। সে নিজেই তাদেরকে আপ্যায়ন করালো। এরকম জীবন যাপনে সবাই চমকায়। কেবল আশ্চর্য হয়না সে। চিত্রা অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে, তার স্বামী বিব্রতকর। বিমর্ষ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সবাই বসে পড়লো। চরম প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ সে এবার পেয়েছে। কিন্তু কোন প্রেমিক তা’কি পারে? যদি সে সত্যিকারের প্রেমিক হয়? চিত্রার স্বামী যা বললো, সে রিপোর্টে যা পড়েছে তার বিপরীত। তার স্বামীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে, মামলা হয়েছে ধর্ষণের। সত্যিই দুর্ভাগ্যবান সে। আবার এ মামলার তদন্তভার পড়েছে তার উপর। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে চিত্রা হবে বিধবা, অন্যথা করলে হবে আইনের অবমাননা। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য সে শপথ নিয়েছে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছে। সামনে বিপদ পিছনেও বিপদ-যাবে কোনদিকে? চিত্রা বিধবা হবে বলবে এটা প্রতিহিংসা। আর রেহাই দিতে গেলে তাকে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হবে। এতে জেল, জরিমানা, চাকুরি সব কিছুই যাবে। চিত্রার বাবা,মা, স্বামী সবাই এসেছিল তার কাছে। গোপন লোভ তাকে টলাতে পারেনি। কিন্তু চিত্রা লোভী মেয়ে। সে চিত্রার সঙ্গে কোন কথা বলেনা। এই ঘৃণিত জন্তুটার সঙ্গে কথা বলতে কোথায় যেন তার বিবেকে লাগে। সে এবং চিত্রা আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত। তথাপি চুপ-চাপ চেপে যায় সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যা হবে আইনেই হবে। তার ন্যায় অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াবেনা সে। আবার পরক্ষণেই মাথায় এক উদ্ভট চিন্তা আসে চিত্রা আমাকে কী ভাববে? প্রেমের প্রতিশোধ বলে আখ্যা দিবে, লোকের মাঝে মিথ্যে অপবাদ ছড়াবে। নারীর কথায় সবাই বিশ্বাস করবে সহজভাবে। কারণ নারী কেবল মা নয় স্ত্রী নয়, অন্যকিছু নয় । নারী হলো এক যন্ত্র। এ যন্ত্রের নাম ভালোলাগার যন্ত্র। এই ভালো লাগার মেশিনটাকে আজ পর্যন্ত কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবেনা। তাহলে কি তদন্ত করার পূর্বে চাকুরী ছেড়ে দেওয়াই যু্ক্তি সঙ্গত? সারারাত বসে বসে কেবল একটি কথাই সে ভাবে। গড়িমসি করে বেশ কয়েকবার সময় পিছিয়ে নিয়েছে সে। কী করা দরকার, কী করা উচিৎ এমন অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি সে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় এর আগে কখনো পড়েনি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সাবলীল ভাবেই কেটেছে। আত্মবিশ্বাসের দরুন সে আজ এমন অবস্থানে অবস্থান করছে। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস সাফল্যের দ্বার খুলে দেয় এটাকে সে বিশ্বাস করে। প্রচন্ড মানসিক চাপ আর দায়িত্ববোধ তিলে-তিলে সেই গভীর ক্ষতে টোকা দিচ্ছে। যার জ্বালা কেবল ভূক্তভোগীই জানে। এমন পরিস্থিতিতে মা বেঁচে থাকলে সে সমস্যার সমাধান দিয়েই ছাড়তেন। মা-নেই, বাবাও কাছে নেই। মা-বাবার শলা-পরামর্শ কত শুনেছে সে। কখনো বিরক্ত হয়ে বলেছে মা তোমার ওই প্যাঁচাল কাহিনী বন্ধ কর। সামনে পরীক্ষা। মা চুপ। একদম চুপ হয়ে থাকতো। মা লেখা-পড়া জানতো না। পরীক্ষার কথা শুনলে যেন অস্থির হয়ে যায়। তাই সে বেশী বেশী আদর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য পরীক্ষার কথা বলত বার বার। মা কখনো প্রশ্ন করে ‘তোর এত পরীক্ষা; মিতু, নিতুর তো বছরে দু’একটা পরীক্ষা।’ সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছে মা, আমি আর মিতু এক? মা ভেবেছে ঠিক তো! ওরা ফেল করে, ফার্স্ট হতে পারেনা। কিন্তু আমার ছেলে ফার্স্ট হবেই। তাই বুকের মধ্যে যত স্নেহ প্রেম ছিল সবটুকুই উজাড় করে দেয়। কিন্তু আজ মায়ের উপদেশ, আদর, মমতা মাখা ভালবাসা যেন সবাই এক কষ্টের স্মৃতি। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে তার জ্বলার সাথে সাথে সেও ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছে। ধুঁকে ধুঁকে জ্বলার যে কী যন্ত্রণা, কী কষ্ট, কী ব্যথা সেটা কেবল ওই বাতি আর সে জানে। চিত্রার সঙ্গে যে দিন সর্ম্পক ছিন্ন হলো সেদিন সে এরকম মানসিক কষ্টে ভুগেনি, পায়নি কোন মানসিক চাপ। তাহলে আজ কেন?গোটা বাড়ী নিঃস্তব্ধ। গেটে পাহারাদার পুলিশের হুইসেল নীরবতাকে ভেঙ্গে দেয়। মৃত্যুর কাছে কি তাহলে পরাজয় বরণ করে নিবে। আত্মহত্যা সে এক মহা-পাপ। চাকুরী ছেড়ে দিলে বাবার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হবে, মায়ের মৃতাত্মা কষ্ট পাবে। এক বছর পরেই ছোটভাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবে। তার স্বপ্ন ব্যারিষ্টার হবে। চাকুরী ছেড়ে দিলে এত টাকার যোগান দিবে কে? বাবা কোন মতে শিক্ষকতা করে সংসার চালাচ্ছে। ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ সে চালায়। বাবা কষ্ট পাবে। সে সবকিছু করতে পারবে কিন্তু মাকে কষ্ট- আঘাত দিতে পারেবনা। বাবা-মা কে কষ্ট দেওয়ার আগে মৃত্যুকে বেছে নিবে অনেক আগে। তৃষ্ণা প্রবল তৃষ্ণা। হাত বাড়াতে না বাড়াতেই পানির গ্লাস টেবিল থেকে পড়ে গেল। যা রইল কেবল তৃষ্ণা আর মেঝেতে গ্লাসের টুকরা। অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল তারা। চারদিকে নীরবতার মাঝে জার্মান কবি জন ডনের কবিতা পড়তে লাগল-
“For God’s sake
Hold your tongue
And let me love”
রাত অনেক হয়েছে। সে চোখের পাতা এক করেনি। তার সাথী কষ্টগুলো তাকে ঘুমোতে দেয়নি। জানালায় গিয়ে তাকায় আকাশের দিকে। কী ব্যাপার? দারোয়ান কার সাথে যেন কথা বলছে। একটি ছেলে ধীরে ধীরে বাড়ীর দিকে এগোচ্ছে। আবছা আলো তাই ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। এভাবে যখন তার দরোজায় নক করল। সে দরজা খুলে চমকে উঠল। চেয়ে থাকল ছেলেটির দিকে। এই ছেলেটির বয়স যখন এগারো মাস তখন তার মা মানে আমার মা মারা যায়। তার কান্নার শব্দে মাঝে-মাঝে মনে হতো সেও কেন মরে গেল না। অথচ আজ সে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। কে জানত ছেলেটি বেঁচে থাকবে? সবাই ধরে নিয়েছিল মরেই যাবে? কিন্তু মরলোনা! সে প্রশ্ন করল প্রনম ব্যাপার কী? এত রাতে? প্রনম জানাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ তাই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। সন্ধ্যার ট্রেনে রওয়ানা হয়েছি। ‘অ্যারে, এতো পুরনো সংস্কৃতির চর্চা! ভাবতে অবাক লাগে আমরা খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, পোশাক-আশাকে, নাচে-গানে, নববর্ষ বরণ, সিনেমায় পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করছি, তখন পাশ্চাত্যের অনুসরনে শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী পরিবর্তন আনা যায় না। যায়! এতে সুবিধাবাদীদের সুবিধা থাকবেনা। বলে বিভ্রান্তের জালে স্বেচ্ছায় জড়াই অথচ অন্য ক্ষেত্রে আধুনিকতার লেভেল লাগাই! বাহ! চমৎকার এদেশের দৃশ্যপট! সে তদন্ত শুরু করে। রিপোর্টও প্রদান করে। পৃথিবীতে যখন কেউ ভালোবাসাকে অপমান করতে পারেনি, তখন সেও পারেনি। ভালোবাসার বিনিময়ে সে যা করেছে তাতে অপরাধী কিন্তু ভালোবাসার আদালতে সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। এরপর অনেক ঘটনা ঘটে যায়। প্রনম ব্যারিষ্টারী পাশ করেছে। সে সাময়িকভাবে চাকুরী থেকে বরখাস্ত হলো। রাষ্ট্র বাদী মামলা হলো। কারণ চিত্রার স্বামী অন্যত্র বদলী হওয়ার পর পরই আবার দুনীর্তি শুরু করে। মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে সমস্ত মামলার পুনঃতদন্তে কারচুপির কথা বলে দেয় চিত্রার স্বামী। সে হতবাক! পুলিশি জেরার মুখে সে সব স্বীকার করেছে। মামলা চলছে। প্রনম বলছে ‘দাদা তুমি ভালোবাসার আদালতে যেমন নির্দোষ তেমনি এই আদালতেও তাই প্রমাণ করবো।’ এরকম কথা বার্তায় সে কেবল হেসেছে। প্রণমি বলছে,‘দাদা হয় আইনের ব্যবসা করবো নয়তো ছেড়ে দিবো।’ প্রনমি, প্রণমের বন্ধু,বান্ধবী, প্রেমিকা,হবু স্ত্রী। একজন ব্যারিষ্টার অন্যজন আইনজীবী। সে প্রণম-প্রণমিকে ডেকে বললো তোদের প্রেমের সূত্রটা আমাকে বলবি যে সূত্র দিয়ে আমি আমার অংকটা কষবো। তারা অবনত মস্তকে চুপ-চাপ চেয়েছিল নীচের দিকে। দাদা অনেক কষ্ট করে মানুষ হয়েছে সুখ নামক শব্দটা তার হয়তো অচেনাই রয়ে গেল। ‘সে’ যে দিন মামলায় অব্যাহতি পেল পরের দিন চাকুরী ছেড়ে দিল। গ্রামের বাড়ীতে কিছুদিন কাটাল। গ্রামের লোকেরা নানা রটনা রটাতে শুরু করলো। শহর-গ্রাম কোথাও শান্তি নাই। অশান্তি দেশটাকে সর্বাঙ্গে গ্রাস করেছে। সে ছাত্রও ভালো। মেধাও ভালো। এক বন্ধুকে ধরে তদবীর করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য। বন্ধুটি কটাক্ষ করে বলেছে ‘কত করে বললাম আরে টাকা নেই। সম্মান হয়তো কম, ক্ষমতা নেই কিন্তু সুখ আর শান্তি পাওয়া যায় এ পেশায়। এ পেশা মহান পেশা। ছাত্র-ছাত্রী বই আর জ্ঞান চর্চা যেন এক অপূর্ব পরিবেশ। তুই কিনা পাবলিক প্রশাসনে যাবি বুঝলিতো এবার।’ বন্ধুটির আশ্বাস পেয়েছে সে দরখাস্ত পেয়েছে। শিক্ষকতা করবে সে। তাদের মতো ছাত্রদেরকে স্বাগতম জানানোর জন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুত। সেখানে সে কেন তাদের বাহিরে থাকবে? সে নিয়োগপত্র পেয়েছে। যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। ট্রেনে প্রচন্ড ঝাঁকুনি আর জীবনের হিসাব না মিলার জন্য তার মাথা ধরেছে। এবারও কি কাঙ্খিত যোগবোধক সংখ্যাটি আসবেনা? সে সবচেয়ে নির্মম সত্য শিখেছে যে কেউ জীবনের হিসাব মিলাতে পারেনা; তথাপি সকলে চেষ্টা করে, যেটুকু মিলায় তা তার চেষ্টার ফসল; এরকম ভাবছে আর সে জানালায় উঁকি দিচ্ছে মনে পড়ে যাচ্ছে অতীত। একে একে সরে যাচ্ছে দ্রুত, তার কষ্টের স্মৃতিগুলো। সে স্বপ্ন দেখছে আদর্শ শিক্ষক হবার। ভাবনা আর ট্রেন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘সে’ একটি ব্যক্তি, একটি চরিত্র এ গল্পের নায়ক। ব্যর্থ, বেদনার মূর্ত প্রতীক ‘সে’ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত,ভগ্নহৃদয়ের অধিকারী এ নায়ক। তবুও ‘সে’ স্বপ্ন দেখে এদেশের, এদেশের মানুষের———–।
1 টি মন্তব্য:
জীবনের গল্প
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন