লালনের কন্ঠে যখন ধ্বনিত হয়- “রবেনা এ ধন, জীবন ও যৌবন, তবে কেন মন এতো বাসনা।” এ গানে ষড়রিপুর প্রথম রিপু কামের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে ষড়রিপুর কথা বলা হয়েছে -কাম কিংবা যৌনতা হলো প্রথম ও প্রধান। বলা হয়ে থাকে যে, এই কাম বা যৌনতা মানুষের অনিষ্টের মূলে থাকে। গ্রামীন বাংলায় প্রচলিত ছড়া- “আও, বাও, নারী, এই তিন হলো পড়ার বৈরী।” অর্থ্যাৎ কথা, শব্দ এবং নারী- এই তিন পড়াশোনার জন্য খুবই ক্ষতিকর। পড়াশোন করে যদি কেউ উন্নতি- করতে চায় তবে তাকে এই তিন শত্রু হতে দূরে থাকতে হবে। সে যাই হোক, নারীর মূলে যে কাম-একে কাজে নেশা বা পেশা হিসেবে বিবেচনা করলেও মানব সৃষ্টির মূলে আছে এই কামযন্ত্র। তাই তো লালনের কন্ঠে আমরা শুনতে পাই “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছ, আমরা ভেবে করবো কী? ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম,তাকে তোমরা বলো কি।”আদি শুক্রানু ও ডিম্বানুর যে সম্মিলিন, যে প্রক্রিয়ায় সন্তান পুনরৎপাদন তাকে লালন সাঁইজি বলেছেন চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে। দুই চাঁদের মিলনে- ছেলে বা মেয়ে কি হবে সেটা আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য জ্ঞান। ফিরে যাই গানের কথায়- সন্তান বা মেয়ের সন্তান জন্মদানের পূর্বে এলাকা ভেদে তাকে কন্যা/ঝি বলে বিবেচনা করা হয়। আর যখনই কন্যা/ঝি সন্তান জন্মদান করে. তখন তাকে মা বলে অভিহিত করা হয়। এই মা কিংবা মাতৃত্বদানের প্রক্রিয়ায় ওতোপ্রতোভাবে জড়িত যৌনতা। অথচ এই যৌনতা সংক্রান্ত আলোচনা সমাজে অপ্রত্যাশিত আলোচনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটা কুর্তকও বটে অথচ এর প্রয়োজন ও প্রয়োগ অবশ্যাম্ভাবীভাবে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জাতি বিনির্মানে।
যদিও সামাজিক বিজ্ঞানে মনে করা হয় “কেউ নারীরূপ জন্ম নেয় না বরং হয়ে উঠে নারী। সমাজে যে নারী দেখা যায়-কোনো জৈব, মনস্তাত্ত্বিক বা অর্থনৈতিক ভাগ্য তার রূপ স্থির করে না (বেভোয়ার-১৯৪৯)।” তাই, সৃষ্টিকাল বা চিরায়ত কাল হতে চলে আসা নারী আমাদের কাছে একখন্ড মাংস বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।পুঁজিবাদ ক্রমশঃএ ধারনাকে ত্বরান্বিত করেছে তার প্রসার ও প্রচারের স্বার্থে। তাই নারীর যৌন অঙ্গঁ প্রত্যঙ্গগুলো ঢাকা রহস্যে আর নিষেধে কিন্তু অর্থনীতি এ দুয়ের সুযোগ গ্রহণ করেছে বাণিজ্যিকায়ন নামকরনের মাধ্যমে। ফলে, রহস্যময়তায় পরিপূর্ণ,আর আকর্ষণীয় অঙ্গগুলো সম্পর্কে জানা ও জানানোও নিষেধ মূলতঃ নিম্নবর্গীয় ও মধ্যবিত্ত দর্শনে-কিংবা অপরাধ আমাদের হাল সমাজের এ বাস্তবতায় বিজ্ঞাপন তা উন্মুক্ত করে পসরা সাজিয়ে রেখেছেন আমাদের চোখের সামনে। নারীর একটি অঙ্গ স্তন যার বাহারি প্রদর্শন-অধিকাংশ পুরুষের চোখে এর আবেদন তীব্র বলে ধরা হয়। যুগে যুগে এ অঙ্গের বর্ণনা করেছেন সকল কবি-সাহিত্যিকগণ। তাঁরা নারীর প্রত্যেক অঙ্গের অবারিত রূপ ও সৌন্দর্য্যের বর্ণনা করেছেন অকৃপণভাবেই। কবি এ্যান্ডু মার্ভেলের মতে’ প্রত্যেক স্তনের বর্ণনায় লাগে দু’শো বছর (রাবেয়া মঈন:১৯৮৯:০৮)।” আর বাংলা সাহিত্যে এ স্তনের উপর হয় পিএইচডি এবং গ্রণ্থাকারে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা বিমোহিত নারী গবেষকের দৃষ্টিতে বক্ষ বন্দনা তাইতো রমনীর গৌরবের বক্ষ, কালে কালে কবি- সাহিত্যিকগণের বক্ষ বিষয়কে গবেষণার ব্যাপক অবকাশ রয়েছে বলে মনে করা হয় (রাবেয়া মঈন:১৯৮৯)।
যাই হোক, নারীর যৌন অঙ্গগুলো প্রধানত: দুই ভাগে বিভক্ত। যথা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরিক। নারীর বাহ্যিক যৌন প্রত্যঙ্গ এলাকার নাম যৌনাঞ্চল বা ভালভা। আপ-লিনিয়ের এ এলাকাকেই বলেছিল ” বিশুদ্ধ ত্রিভুজ”। পুরুষ দক্ষতার সাথে খুঁজে এ ত্রিভুজ আর অভিজ্ঞ অথবা দক্ষতার অভাবেই এখানে আগুন জ্বলে অনুপস্থিতির কারনেও।
রাধার কোন অঙ্গঁ জ্বলে যায় বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা বা ধারণা না পাওয়া গেলেও সহসাই অনুমান করা যায় এটি একটি ত্রিভূজ এবং এ অঙ্গেঁর বিশেষ বিবরণ আমরা পাই- হুমায়ুন আজাদের (২০১১) এবং পৃথ্বীরাজের (১৪০৭ বঙ্গাব্দ) লেখায়। উক্ত গ্রণ্থ সমূহ হতে তুলে ধরা হলো পাঠকের মর্মের উপলব্ধির জন্য যাতে অন্তরে শুনতে পান এর ধ্বনি, প্রতিধ্বনি যাত করে অনুরণিত হবে হৃদয়ের স্পন্দন। ”নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো ঢাকা রহস্যে আর নিষেধে। নারীর শরীর যেনো আকর্ষণীয় রহস্যময় ভীতিকর দূর্গ যার সংগঠন সে নিজে জানে না; জানাও নিষেধ। আজো মানুষের সবচেয়ে বড়ো ট্যাবু নারীর শরীর। তার একটি প্রত্যঙ্গ, স্তন, দৃষ্টিগ্রাহ্য; অধিকাংশ সংস্কৃতির পুরুষের চোখে ওটির আবেদন তীব্র, যদিও আদিম সমাজের পুরুষের চোখে ওর কোনো আবেদন নেই। তবে নারীর অধিকাংশ যৌন প্রত্যঙ্গ দেহাভ্যন্তর ও অদৃশ্য, আর যেগুলো বাহ্যিক সেগুলোও অন্তরালবর্তী। একটি নগ্ন নারী দিকে তাকিয়ে থেকেও তার কোনো যৌনপ্রত্যঙ্গ দেখা যায় না, শুধু আভাসের ঢেউ উঠতে থাকে। বালক শিশুর শিশ্নটি বাইর থেকে দেখা যায়, ‘কী মিষ্টি’ ব’লে ওটি নিয়ে তার পিতামাতারা খেলাও করে, ওটিকে দেয় নানা প্রিয় ডাকনাম;- সোনা, নুনু, ধন; কিন্তু বালিকার বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গের কোনটি কেমন, কোনটির কী নাম ও কী কাজ তা জানতে দেয়া হয় না বালিকাকে, জানতে চাইলে তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। যেনো ওগুলো অপার লজ্জার, ঘৃণার, অপরাধের, এমনকি পাপের। তাই নারী শৈশব থেকেই বিব্রত থাকে তার যৌনপ্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে। এগুলো তার লজ্জা, লজ্জাস্থান; ওগুলো দেখতে নেই, দেখাতে নেই, ছুঁতে নেই, ছুঁতে দিতে নেই, ওগুলোর নাম নিতে নেই। অনেক ভাষায় বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হয় ‘লজ্জাস্থান’, এগুলোর চিকিৎসাশাস্ত্রীয় পরিভাষা হচ্ছে ‘পুডেনডাম’ অর্থাৎ লজ্জার বিষয়। প্রথাগত লজ্জা, ঘৃণা, পাপ আর অপরাধবোধের সাথে আরেকটি দুর্নাম জড়িত করে দিয়েছেন ফ্রয়েড; তিনি নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোকে দেখেছেন বিকলাঙ্গতা হিসাবে।নারীর শিশ্ন নেই, রয়েছে ভগাঙ্কুর; তাই নারী বোধ করে শিশ্নের অভাব, ভোগে খোঁজাগূঢ়ৈষায়, নিজেকে মনে করে বিকলাঙ্গ পুরুষ, এসব বাজে ধারণা তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন নারী যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোর সাথে। এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। নারীর যৌন প্রত্যঙ্গগুলো নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গ, ওগুলো একশো ভাগ স্বাভাবিক; আর ওগুলো লজ্জা, অপরাধ, ঘৃণা বা পাপের ব্যাপার নয়। তবু কোনো নারী নির্দ্বিধায় ছুঁতে পারে না তার প্রত্যঙ্গ, কেননা ওগুলো নিষিদ্ধ। প্রতিটি নারীর জানা উচিত তার আভ্যন্ত ও বাহ্যিক প্রত্যঙ্গগুলো, তবে শুধু অশিক্ষিত নারীরাই নয়, শিক্ষিত নারীরাও জানে না তাদের প্রত্যঙ্গগুলোকে ও সেগুলোর ক্রিয়াকলাপ। শৈশব থেকে তাদের বার বার দেখা দরকার নিজেদের প্রত্যঙ্গগুলো, বিশ্বাস করা দরকার যে ওগুলো কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নয়। ওগুলো নিয়ে বিব্রত হয়ে থাকার জন্যে প্রকৃতি ওগুলো দেয়নি নারীকে।
নারীর যৌনপ্রত্যঙ্গগুলোর কয়েকটি বাহ্যিক, কয়েকটি অভ্যন্তরিক। তবে এগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে নগ্ন হলেও, স্তন ছাড়া, নারী কখনো নগ্ন নয়। নারীর বাহ্যিক যৌনপ্রত্যঙ্গ এলাকার নাম যৌনাঞ্চল (ভালভা)। চমৎকার এলাকা এটি, আপলিনিয়ের এ-এলাকাকেই বলেছিলেন ‘বিশুদ্ধ ত্রিভুজ’। এ-এলাকায় রয়েছে কয়েকটি প্রত্যঙ্গ, যেগুলো পালন করে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব। এগুলো নারীর বাইরের যৌনপ্রত্যঙ্গ, কিন্তু বাহির থেকে দেখা যায় না, দেখার জন্যে তাকাতে হয় কাছ থেকে, দেখতে হয় আঙ্গুল দিয়ে ফুলের পাপড়ির মতো নেড়ে নেড়ে।” আজাদ এবং পৃথ্বীরাজ উভয়ে নিখুতঁভাবে বিবরণ দিয়েছেন যা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
বৃহদোষ্ঠ: এটি হচ্ছে দু-ভাঁজ চামড়া: ঠোঁট যেমন মুখগহ্বরকে ঢেকে রাখে এ-দুটিও ঢেকে রাখে এ-দুটির মধ্যবর্তী ভগগহ্বরকে। দুটি বড়ো মোটা গোলাপপাপড়ি ব’লে মনে হ’তে পারে এ-দুটিকে। শিশু ও বুড়োকালে বৃহদোষ্ঠ দুটি থাকে ছোটো, ভেতরে মেদ থাকে না, তবে বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ হওয়া পর্যন্ত বৃহদোষ্ঠ থাকে পরিপুষ্ট। ওপরের দিকে বৃহদোষ্ঠ দুটি মিলিত হয় এক মেদপুষ্ট অঞ্চলে, যাকে বলা হয় ভেনাসের পাহাড় [মোন্স ভেনারিস] বা যোনি বিটপ। বৃহদোষ্ঠ, বিশেষ ক’রে মোন্স ভেনারিসের ওপর উদগত হয় যৌনকেশ।
ক্ষুদ্রোষ্ঠ: এ-দুটি মেদপুষ্ট স্পর্শকাতর চামড়ার ভাঁজ, গোলাপের ছোটো পাপড়ির মতো। ওপরের দিকে এ-দুটির একটি চলে যায় ভগাঙ্কুরের ওপরে, আরেকটি ভগাঙ্কুরের নিচে; নিচের দিকে এ-দুটি মিলিত হয় পরস্পরের সাথে। বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত এটি গুপ্ত থাকে বৃহদোষ্ঠের আড়ালে, দেখতে হয় আঙুল দিয়ে খুলে; তবে শিশু ও বুড়োকালে এ-দুটি বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে।
ভগাঙ্কুর: পুরুষের যেমন শিশ্ন নারীর তেমন ভগাঙ্কুর; তবে শিশ্নের যৌন ছাড়া অন্য কাজ রয়েছে, কিন্তু ভগাঙ্কুরের একমাত্র কাজ যৌনসুখ অনুভব। তাই এটি অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ, পুরুষের এমন কোনো অনন্য কামপ্রত্যঙ্গ নেই। এটি যেহেতু শুধু কামসুখের জন্যেই, আর কোনো কাজের জন্যে নয়, তাই দেশে দেশে পিতৃতন্ত্র এর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে এটি কেটে ফেলার বিধান দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক মুসলমান দেশে এখনো ভগাঙ্কুরছেদ বা নারীর খৎনা প্রচলিত রয়েছে। এটি কেটে ফেলার অর্থ হচ্ছে নারীর কামসুখের চিরাবসান। গত কয়েক দশকে নারীবাদীরা, ও মাস্টার্স্ ও জনসনের গবেষণা, প্রতিষ্ঠা করেছেন এর প্রাধান্য। তাঁদের মতে অরগাজম বা পুলকের জন্যে সঙ্গম অপ্রয়োজনীয়, এটি মৈথুন ক’রেই অনুভব করা সম্ভব চরম পুলক। ইলিয়েরসেন “আমি অভিযোগ করি” (১৯৬৯) নামের বইতে লিখেছেন (দ্র. গ্রিয়ার (১৯৭১, ৪৩)- (যৌনবিজ্ঞানীরা) পরামর্শ দেন যে সঙ্গমের অবতরণিকা হিসাবে নাড়তে হবে ভগাঙ্কুরটিকে,সঙ্গমকেই অধিকাংশ পুরুষ মনে করে ‘আসল জিনিশ’। তাদের জন্যে যা ‘আসল জিনিশ’,নারীর জন্যে তা পুরোপুরি সুখানুভূতিহীন এখানেই পুরুষ শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে জয়ী হতে চায়। এটিই হচ্ছে মূল জিনিশ! যাকে বিনীত, লজ্জাশীল ও অনুগত নারীরা শতো শতো বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে। এটি অবস্থিত যৌনাঞ্চলের ওপরের দিকে মধ্যস্থলে। এটি মোটা শিউলিবোঁটার মতো, এর রয়েছে তিনটি অংশ: শীর্ষ, শরীরদন্ড, ও পা। এর শীর্ষটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, দন্ডটিও বেশ স্পর্শকাতর। শীর্ষ ও দন্ড নেড়েই নারী পেতে পারে চরম পুলক। সঙ্গমে নারী পুলক বোধ করে প্রধানত শিশ্নের সাথে এটির ঘর্ষণে। অনেক নারী সঙ্গমে কোনো পুলক বোধ করে না, কিন্তু তারা ভগাঙ্কুর মৈথুন ক’রে চরম পুলক লাভ করে।
যোনিচ্ছেদ: মূত্ররন্ধ্রের নিচে অবস্থিত নারীর যোনিমুখ, যেটি সাধারনত ঢাকা থাকে একটি পাতলা পর্দায়। পর্দাটির প্রথাগত নাম সতীচ্ছদ, তবে এটি থাকা-না-থাকা তথাকথিত সতীত্বের প্রমান-অপ্রমান নয়। সতীত্ব ব’লে কিছু নেই; এটি না থাকার অর্থ এটি নেই। এটিকে যোনিচ্ছদ বলাই ভালো। এটি এক অপ্রয়োজনীয় জিনিশ। এটি একটি পাতলা পর্দা, যাতে থাকে এক বা একাধিক ছিদ্র, যার ভেতর দিয়ে নিঃসৃত হয় ঋতুসাব। এটির আকার ও স্থিতিস্থাপকতা ভিন্ন হয়ে থাকে নারী থেকে নারীতে; সঙ্গম না করেও এটি ছিঁড়ে যেতে পারে, আবার বহুসঙ্গমেও থাকতে পারে অটুট। এটি ছেঁড়ার সময় সাধারণত কিছুটা রক্ত বেরোয়। অনেক সমাজে যোনিচ্ছেদ ছেঁড়া ও রক্তক্ষরণকে মনে করা হয় নারীর সতীত্বের প্রমাণ।
নারীর আভ্যন্তর যৌনপ্রত্যঙ্গের মধ্যে রয়েছে যোনি, জরায়ু, ডিম্বনালি বা ফ্যালোপীয় নালি, ও ডিম্বাশয়।
যোনি: এটি পুরুষের প্রধান স্বপ্ন ও একই সাথে দুঃস্বপ্ন। পুরুষ এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করে এমনকি ভয় পায় ও ঘৃণা করে এটিকে। যোনি একটি পেশল নালি, এটি পেছনের দিকে উঁচু হয়ে গিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে। এটি পেশিতে গঠিত, এবং এতে আছে রক্তবাহী শিরাজাল, যা কামোত্তেজনার সময় ফুলে ওঠে। স্বাভাবিকভাবে যোনির দেয়াল লেগে থাকে পরস্পরের সাথে; তবে এটি যেহেতু স্থিতিস্থাপক, তাই এর ভেতর দিয়ে লিঙ্গ বা ট্যাম্পুন প্রবেশের বা সন্তান প্রসবের সময় এটি বিস্ময়করভাবে প্রসারিত হয়। যোনি সাধারণত ৩.৭৫ ইঞ্চি দীর্ঘ। জরায়ুর গ্রীবা বা সারভিক্স ঢুকে পড়ে এর ভেতর। যোনি প্রত্যঙ্গ হিসেবে বিস্ময়কর। এটা শুধু স্থিতিস্থাপকই নয়, এটির আছে নিজেকে নিজে পরিচ্ছন্ন রাখার শক্তি।নারীর আভ্যন্তর প্রত্যঙ্গগুলোর মধ্যে এটিই বেশি লিপ্ত হয় কামে; সাধারণ বোধে এটিই নারীর একমাত্র কামপ্রত্যঙ্গ। পুরুষ এটির ভেতরে শিশ্ন ঘর্ষণ ও ধাতুপাত করেই চরম সুখ পায়। এটির সব অংশ সমান স্পর্শকাতর নয়, এর মধ্যভাগের কোনো স্পর্শকাতরতাই নেই, শুরু ও শেষভাগের রয়েছে কিছুটা স্পর্শকাতরতা। তাই শুধু এটির ভেতরে সঙ্গম করা হলে নারী পুলক বোধ করে না অথচ পুরুষ এটা বুঝতেই চায়না। ছোটো যোনি বলে কিছু নেই, যে কোনো যোনিতে প্রবেশ করতে পারে যে-কোনো শিশ্ন। কামোত্তেজনার সময় যোনি সিক্ত হয়, সিক্ততা শিশ্নের প্রবেশের সহায়ক। যোনি কোনো অক্রিয় প্রত্যঙ্গ নয়, সঙ্গমের সময় এটি শিশ্নকে জিভের মতো চুষতে পারে।
জরায়ু: জরায়ু আরো বিস্ময়কর। গর্ভধারণের আগে এটি দেখতে অনেকটা নাশপাতির মতো, দৈর্ঘে প্রায় চার ইঞ্চি, পাশে আড়াই ইঞ্চির মতো, ওজন দু-আউন্স। গর্ভধারণের সময় এটির ওজন হয় আড়াই পাউন্ড, ধারণ করতে পারে সতেরো ইঞ্চি দীর্ঘ একটি শিশু। সন্তান জরায়ুতে উদ্ভূত হয় না, লালিত হয়। জরায়ু এক শূন্য পেশল আধার, এর সামনে মূত্রাশয় পেছনে মলাশয়।
প্রেম ও কাম এবং চিরায়ত নারী তিনটিই পরস্পরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। নারীকে কাপড় পড়িয়েছে পুরুষ তার যৌনতার স্বার্থেই। আবার অল্প, স্বল্প বসনায় ভূষিত করে বাণিজ্যিক স্বার্থ কাজে লাগিয়েছে অর্থনৈতিক তথা পুঁজিপতিদের স্বার্থে। সুতরাং প্রেম ও কাম পরস্পর সম্পর্কিত হলেও দুটিই নারী পুরুষের জীবনে বিশেষ পাঠ প্রবল ভাবে দেখা দেয়; যদিও জীবনে দুটির গুরুত্ব সমান নয়। প্রেম স্বল্পায়ু, মানুষ প্রেমে বাচেঁনা কিন্তু কাম ছাড়া চলেনা। বলা হয় প্রেম- জোয়ারের ন্যায় বিশেষ বিশেষ সময়ে দেখা যায় বা উপলব্ধি করা হয় মাত্র। এ কারণে বলা হয় যে, যাকে চাই তাকে না পাওয়া প্রেম, তাকে পাওয়া কাম। প্রেম পুরুষের জীবনের একটি অংশ হলেও তা নারীর সমগ্র অস্তিত্ব। তাহলে প্রশ্ন আসে রাধার জীবনে কোনটি? নাকি দুটোই ঘটেছে? সূত্রানুসারে কৃষ্ণ প্রথমে রাধারে না পেলে তা প্রেম বলে ধরা যেতো। কিন্তু রাধার সম্মতিতে তা মিলনও ঘটে যমুনার কূলে। অতঃপর কৃষ্ণের বিচ্ছেদে রাধা পুনরায় প্রেমে জ্বলতে থাকে। ফলে নারীর জীবনে প্রেম ও কাম সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে, তাই এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে কথা-উপকথা প্রচলিত রয়েছে তা জৈবিক নয় বলে মতামত পাওয়া যায় বরং এ সকল সম্পর্ক সামাজিক পরিস্থিতির পরিণতি বা স্বীকার। এহেতু, উদাহরণ হিসেবে পরকীয়া প্রেমকে এরকম সামাজিক সম্পর্কের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
নিটশের মতে- “পুরুষ ও নারীর কাছে একই শব্দ “প্রেম” বোঝায় দুই জিনিস। নারী প্রেম বলতে যা বোঝে তা খুবই স্পষ্ট তা শুধু ভক্তি নয় তা প্রত্যাশাহীন নিঃশর্ত সম্পূর্ণ দেহমন সমর্পন। অর্থ্যাৎ যৌনতার অবাধ বিচরণ।
আজাদ (২০০০) উল্লেখ করেন-নারীর কাম সম্পর্কে পুরুষতন্ত্রে দুটি বিরোধী ধারণা পোষণ ও প্রচার করা হয়। একটি হচ্ছে-নারীর কাম ক্ষুধার শেষ নেই; কিছুতেই এই আগুন নিভানো যায়না। অন্যটি হচ্ছে নারী কাম পছন্দ করেনা। নারী প্রাকৃতিকভাবে এক পুরুষেই পরিতৃপ্ত। পরকীয়া বা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ক্ষেত্রেই প্রথম ধারণাটাই যুক্তিযুক্ত বলে প্রয়োগ করা যায়।
কিন্তু দ্বিতীয় ধারনার স্বপক্ষে আমরা নজরুলের পূজারী কবিতায় পাই এভাবে-
“এরা লোভী, এর দেবী
যত পূজা পায়, চায় তত আরো
একজনে সুখী নয়, যাচে বহু জন।”
আদি পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ককে বুঝতে সহায়ক প্রথম ধারণাটি। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, নারীর-কাম সমভাগেই আপত্তি নাই। তবে, পুরুষতন্ত্রের ন্যায় অধিকাংশ নারীই তা স্বীকার করেনা। রাধাকে আমরা তথাগত বিপ্লবী ও যৌন প্রতিবাদী বিবেচনা করে বলতে পারি যে, বাখোফোনের তত্ত্বের নাকচতাকেই ইতিপূর্বে অসাড়তা বলে রাধা, নারী মুক্তি জন্য যৌনমুক্তির যে আন্দোলন শুরু করে ছিলেন; তার উত্তরসূরীরা এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে নারীর মননে পৌরুষতান্ত্রিক মনোভাব লালন ও পালনে। ফলে, নারীর মুক্তির মূল ক্ষেত্রকে আঘাত করা বাদ দিয়ে নারীর মুক্তি তাই বেশীদূর এগোয়নি। কারণ যেখানে পুনরৎপাদন জড়িত, সেখানেই নারীর বিনির্মান সম্ভব নয় বলে এই মহীয়সী নারী বার্তা দিয়ে গেছেন কয়েক হাজার বছর পূর্বে। তাইতো, আমরা এ সময়ের তাত্ত্বিকদের লেখায় পাই-ক্যাথেরিন ম্যাককিনন (১৯৮২:১)এ-“মার্ক্সবাদে যেমন শ্রম,নারীবাদে তেমন কাম: যা মানুষের একান্ত আপন, কিন্তু তা হরণ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশী।” কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে আমাদের নারীবাদীরা নারীমুক্তির জন্য এই কামের বা যৌনতার বিযুক্ত সম্পর্কের কথা বলেছেন খুবই কম। অথচ নারীর যৌন ও আবেগগত প্রবণতা গভীর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার চেতনা ও সৃষ্টিশীলতাকে (আজাদ (২০০০)। [নারী মুক্তির জন্য নারীবাদী কথাগুলো- (আজাদ:২০০০)। নারীপুরুষ কেউ অসম নয়, তাদের কারো ভূমিকা কম মূল্যবান নয়; তাদের উভয়ের ভূমিকাই সমান মূল্যবান, তবে তাদের ভূমিকা ভিন্ন। তারা সমান, তবে পরস্পরের পরিপূরক। রক্ষণশীলেরা মনে করেন নারী ও পুরুষের ভূমিকা ভিন্ন; ভিন্ন ভূমিকা ঠিক মতো পালন করাই তাদের সার্থকতা। তাঁরা শুধু নারীপুরুষের ভিন্নতা ও ভিন্ন ভূমিকায় বিশ্বাস করে না,তাঁরা মনে করেন সমাজরাষ্ট্রে বিধিবিধান প্রবর্তন করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ভিন্নতা। তাঁরা বিশ্বাস করেন নারীপুরুষের সহজাত ভিন্নতায় ও অসাম্যে; পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে, নারীর নিকৃষ্টতায়। তাঁরা মনে করেন নারীপুরুষ একই কাজের উপযুক্ত নয়,নারী উপযুক্ত নিকৃষ্ট কাজের, তাই সেগুলোই পালন করবে নারী। তাঁদের চোখে এটা অন্যায় তো নয়ই, বরং এটাই ন্যায়সঙ্গত; কেননা নিকৃষ্টকে নিকৃষ্টরূপেই রাখাই ন্যায়।
নারীপুরুষ সমান, তাদের অধিকার অভিন্ন-এ হচ্ছে নারীবাদ। একে মনে হয় সরল, দিবালোকের মতো স্বচ্ছ, সত্য বলে। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে মানা হয়নি এ সরল সত্যটুকু। নারীবাদীরা মনে করেন মৌল যৌগ্যতায় কোনো পার্থক্য নেই নরনারীতে; নারী ও পুরুষের মূল পরিচয় তাদের স্ত্রী বা পুংলিঙ্গ নয়, তাদের মূল পরিচয় তারা মানুষ।মানুষের প্রকৃতি ও যোগ্যতা লিঙ্গনিরপেক্ষ। কিন্তু পিতৃতন্ত্র এটা মানে নি। নারীবাদীদের বিদ্রোহ নারীপুরুষের অসাম্যের ধারণা ও অসম অধিকারের বিরুদ্ধে; তাঁরা মনে করেন প্রথাগতভাবে নারীপুরুষকে যে মনে করা হয় অসম বলে, এবং নারীদের যে রেখে দেয়া হয়েছে নিম্নতর সামাজিক অবস্থানে, তা অন্যায়। তাঁরা সবাই মনে করেন পরিবর্তন ঘটাতে হবে এ-ব্যবস্থার, তবে কী পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সে-সম্পর্কে তাঁরা পোষণ করেন নানা মত। নারীমুক্তির জন্যে কী কৌশল নিতে হবে, সে-সম্পর্কেই শুধু তাঁরা ভিন্ন মত পোষণ করেন না; তাঁদের ভিন্নতা আরো গভীর স্তরের। নারীর প্রকৃত স্বার্থ কী, কি হ’লে প্রকৃতই মুক্ত ঘটবে নারীর, এ সম্পর্কে বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক দেন বিভিন্ন মত। নারীবাদে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্বাদর্শ, প্রতিটিই বিশ্বাস করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে দরকার নারীর স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে সাম্য; কিন্তু বিভিন্ন মৌল বিষয়ে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা ভিন্নতা। প্রকৃত স্বাধীনতা ও সাম্য কী, মানুষ বা নারীর প্রকৃত স্বভাব বা প্রকৃতি কী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী হবে, এসব বিষয়ে তাঁদের মধ্যে রয়েছে দার্শনিক ভিন্নতা। নারীমুক্তি সম্পর্কে কয়েকটি তত্ত্বাদর্শ রয়েছে; এগুলো হচ্ছে ‘রক্ষণশীল মতবাদ’, ‘উদার (মানবতাবাদী) বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ’, ‘মার্ক্সীয় নারীবাদ’, ‘আমূল নারীবাদ’। রক্ষণশীল মতবাদটি নারীর মুক্তিবিরোধী, এটি ছাড়া অন্যগুলো বিশ্বাস করে নারীমুক্তিতে।
রক্ষণশীল মতবাদ-এটি নারীমুক্তির বিরোধী, এটি পোষে প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাস যে নারী যেভাবে যে অবস্থানে আছে, তাই ঠিক। নারীবাদের লড়াই এ-মতবাদের বিরুদ্ধেই। এ মতবাদে মিলে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে: ধর্মগ্রন্থ, আইন, দর্শন সবখানেই এ-মতবাদ ছড়িয়ে আছে। এ-মতবাদ অনুসারে নারীরা যে-অসাম্য ভোগ করছে, তা অন্যায় ন্যায়; এই চিরন্তন শাশ্বত। রক্ষণশীলদের মতে কোনো কোনো নারী পোহায় নানা দুর্ভোগ, তবে সমাজ নারীদের সুপরিকল্পিতভাবে পীড়ন করে না।
রক্ষণশীলেরা মনে করেন নারীর যে অবস্থা, তা প্রকৃতিনির্ধারিত, বা বিধাতার নির্দিষ্ট; প্রকৃতি বা বিধাতাই ঠিক করে দিয়েছে যে নারীপুরুষ অসম; পুরুষ প্রভুত্ব করবে, নারী থাকবে তার অনুগত। এটা কোনো অন্যায় নয়, এটা ধ্রুব বিধান। রক্ষণশীলদের মধ্যে যাঁরা এতোটা বর্বর নন, তাঁরা একই কথা একটু মধুর করে বলেন।
উদার (মানবতাবাদী) বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ: এ-মতবাদের উদ্ভব ঘটে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যান-এ (১৭৯২), এবং পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে জন স্টুয়ার্ট মিলের দি সাবজেকশন অফ উইমেন (১৮৬৯) নামক গ্রন্থে প্রকাশের মধ্যে দিয়ে।
এ-মতবাদটিই এখনো প্রধান নারীবাদী ধারা, কেননা পশ্চিমের গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের সাথে এটি বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। এ মতবাদের লক্ষ্য বিভিন্ন বিধান প্রণয়ন করে সামাজিক রাষ্ট্রিকভাবে নারীর অবস্থান উন্নত করা। গণতন্ত্রে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার; তাই এ মতবাদের মূলকথা হচ্ছে পুরুষ যেমন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, স্থির করে নিজের ভূমিকা, নারীকেও তেমনই দিতে হবে সমাজে প্রতিষ্ঠার ও নিজের ভূমিকা স্থির করার অধিকার। উনিশ শতকে এঁদের লক্ষ্য ছিলো ভোটাধিকার পাওয়া, কিন্তু তা পাওয়া সত্ত্বেও নারী আজো অনেক অধিকার পায় নি; কেননা রয়ে গেছে নানা আইন ও প্রথাগত বাধা। এসব বাধার ফলে নারী রাজনীতি, ব্যবসা, সামরিক ও অন্যান্য পেশায় সফল হ’তে পারছে না। উদার নারীবাদীদের দাবি হচ্ছে আইন ক’রে দূর করতে হবে এ-সমস্ত বাধা, প্রতিষ্ঠা করতে হবে সমান নাগরিক অধিকার। এ-মতবাদের বক্তব্য হচ্ছে কোনো ভূমিকায় প্রতিষ্ঠার জন্যে বিবেচনা করতে হবে শুধু ব্যক্তিকে, ব্যক্তির যোগ্যতাকে, আর করতে হবে শুধু ব্যক্তিটিকে। উদার নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে ব্যক্তিগত ব্যাপারে রাষ্ট্র যতো কম হস্তক্ষপে করে ততোই ভালো; তাই রাষ্ট্রের নারীর ওপর অভিভাবকত্বের কোনো দরকার নেই। নারীকে আগে থেকেই বিশেষ কোনো ভূমিকায় আটকে ফেলা অন্যায়; নারী সব ভূমিকায় নিজেকে পরখ ক’রে একদিন নিজেই দেখবে সে কোন ভূমিকার উপযুক্ত।
উদার নারীবাদ হচ্ছে প্রতিটি নারী ও পুরুষের নিজের ইচ্ছে ও শক্তি অনুসারে নিজের ভূমিকা বেছে নেয়ার অধিকার; স্বাধীনতা হচ্ছে নারীর নিজের ইচ্ছেমতো ভূমিকা অর্জনের পথে কোনো বাধা না থাকা। তবে এ-বিষয়ে পুরোনো ও আধুনিক উদার নারীবাদীদের মধ্যে মতের ভিন্নতা রয়েছে। আধুনিকদের মতে, আইন নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টি করতে তো পারবেই না, তার সাথে এমন আইন তৈরি করতে হবে যে সব রকম বৈষম্য অবৈধ। অসম বেতনহার নিষিদ্ধ করতে হবে, যে-সমস্ত পেশায় নারীবিরোধী আইন রয়েছে, সেগুলো অবৈধ করতে হবে, বিশেষ বিশেষ পেশায় নারী নিয়োগ না করে পুরুষ নিয়োগের যে-রীতি রয়েছে, তা নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে বাতিল করতে হবে নারীর স্বার্থবিরোধী সকল আইন। আধুনিক উদার নারীবাদীরা অনেক ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে বৈষম্য সৃষ্টির পক্ষপাতী। তাঁরা দাবি করেন, এতো দিনের বৈষম্য দূর করার জন্যে, এখন অনেক পেশায় পুরুষ না নিয়ে নিতে হবে নারী, এবং বাইরের কাজে অক্ষম নারীদের দিতে হবে বিশেষ ভাতা। যেমন: নারীদের দিতে হবে প্রসব ছুটি ও ভাতা। এটা দয়া নয়, নারীর প্রাপ্য; কেননা সন্তান জন্ম দেয়া একটি সমাজ সেবা। তাঁরা জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাতবিরোধী আইনেরও বিরোধী, কেননা এগুলো ক্ষুন্ন করে নারীর অধিকার। শিশুপালনের ব্যাপারটিকে তাঁরা দেন বিশেষ গুরুত্ব। উদার নারীবাদীদের কাছে নারীস্বাধীনতা হচ্ছে নারীর সামাজিক ভূমিকা নিজে স্থির করার, এবং পুরুষের সাথে সমভাবে প্রতিদ্বন্দিতা করার অধিকার। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। তাঁরা মনে করেন না যে নারীমুক্তির জন্যে বদলে দিতে হবে সমগ্র সমাজসংগঠন; এও মনে করেন না যে সব নারী একই সময়ে লাভ করবে মুক্তি। তাঁরা মনে করেন সবাই মুক্তি পাওয়ার অনেক আগেই কোনো কোনো নারী মুক্তি পেতে পারে। তাঁরা মনে করেন নারীমুক্তি শুধু নারীরই মুক্তি ঘটাবে না, ঘটাবে পুরুষেরও মুক্তি; এতে পুরুষের কিছু অবৈধ সুবিধা কমলেও পুরুষ মুক্তি পাবে সংসারের ভরণপোষণ ও দেশরক্ষার দায়িত্ব থেকে।
মার্ক্সীয় নারীবাদ: এ মতবাদ অনুসারে নারীশোষণ, ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানে, ব্যক্তিমালিকানার ফল; তাই নারীকে মুক্ত করা সম্ভব শুধু ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত ক’রে। মার্ক্সীয়দের মতে নারীমুক্তি-আন্দোলন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক সংগ্রামের একটি অংশ। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার অনেক কারণ রয়েছে, নারীবাদ ওই কারণগুলোর একটি। তাঁদের মতে নারী ও শ্রমিকের স্বার্থ একই, কেননা নারী ও শ্রমিক একই রকমে শোষিত। মার্ক্সীয় নারীবাদের উদ্ভব ঘটে এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) সন্দর্ভে। মার্ক্সবাদ অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অধিকাংশ মানুষই শোষিত। কেননা উৎপাদনের উপকরণগুলো কিছু মানুষের অধিকারে। তারা উপকরণের জোরে আধিপত্য করে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ওপর, যারা বেঁচে থাকার জন্যে সস্তায় বেচে দিতে বাধ্য হয় তাদের শ্রমশক্তি। নারীও এ শোষণের শিকার। মার্ক্সীয়রা স্বীকার করেন যে নারী শিকার হয় আরো বিশেষ কিছু শোষণের, পুরুষ যা থেকে থাকে মুক্ত। তবে শোষণের মূল রয়েছে পুঁজিবাদে, তাই পুঁজিবাদ উৎখাত নারীর জন্যে আরো বেশ জরুরী। মার্ক্সবাদ অনুসারে নারী বিশেষভাবে শোষিত হয় প্রথাগত পরিবারের জন্যে, নারী হচ্ছে পারিবারিক দাসী, কিংবা যৌনদাসী সে বাইরের কোনো উৎপাদনমুখী কাজ অংশ নিতে পারে না। একপতিপত্নী বিয়ে উদ্ভাবনই করা হয়েছিলো কতিপয়ের মুঠোতে ধন জড়ো করার উদ্দেশ্যে; ওই কতিপয় হলো পুরুষ। তাঁদের মতে পরিবার গঠিত হয়েছিলো শ্রেণীবিভক্ত সমাজে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে। পুরুষই পরিবারে সার্বভৌম। এঙ্গেলসের (১৮৮৪: ২২৯) মতে, একপতিপত্নী বিয়ে নির্ভর ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গার্হস্থ্য দাসত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।’ তবে এ-বিয়ে নামে মাত্র একপতিপত্নী বিয়ে; এতে নারীকেই থাকতে হয় সতী, কিন্তু পুরুষের কাছে যৌনসততা চাওয়া হয় না বরং এ সংক্রান্ত চাওয়া অন্যায়। তাই শ্যাম নিরাপরাধ। রাধা হয়ে গেলো কলঙ্কিনি।
মার্ক্সীয়রা বলেননা যে, নারীশোষণ পুঁজিবাদের সৃষ্টি; তবে তাঁদের মতে পুঁজিবাদ নারীশোষণকে বহুগুনে বাড়িয়েছে, এবং নারীকে অবনতির শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। তাঁদের মতে পুঁজিবাদ আর পুরুষাধিপত্য অবিচ্ছেদ্য, একটি শক্তিশালী করে আরেকটিকে। এঙ্গেলস (১৮৮৪: ২২৯, ২৩০) বলেছেন, ‘সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিস্কৃত হয়ে স্ত্রীই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি’, এবং ‘সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে গোটা স্ত্রীজাতিকে আবার নিয়ে আসাই হচ্ছে তাদের মুক্তি প্রথম শর্ত।’ তখন নারী আর স্বামীর ওপর ভরণপোষণের জন্যে নির্ভর করবে না, নারী স্বাধীন হবে। তবে এর জন্যে দরকার সমাজের মৌলিক রূপান্তর। নারী আজো যেসকল কাজ করে-ঘরকন্না, শিশুপালন সব কিছুকে নিয়ে আসতে হবে সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে। তাঁরা মনে করেন নারীমুক্তির জন্যে দরকার পরিবার নামক ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটির মৌলিক পরিবর্তন। এর জন্যে পরিবারের আর্থিক কাজগুলো পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে; রাষ্ট্রই বহন করবে পরিবারের ভার। পুঁজিবাদ এ ভার নেবে না; এ ভার নিতে পারে শুধু সাম্যবাদ। তাই,শুধু সাম্যবাদের মধ্যেই নারী পেতে পারে প্রকৃত মুক্তি। সেখানে আর পরিবারের মধ্যে স্বামীটি থাকবে না আর বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে আর স্ত্রীটি প্রলেতারিয়েত। সাম্যবাদে ধ্বংস হয়ে যাবে ‘আর্থ একক’রূপে বিরাজমান একপতিপত্নীক পরিবার, তবে তা টিকে থাকবে ‘সামাজিক একক’ রূপে। সাম্যবাদেও বিয়ে থাকবে, তবে তা এখনকার মতো অর্থ চুক্তি থাকবে না; তখনও পরিবার থাকবে, তবে তা গড়ে উঠবে নারীপুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণে। তখন নারী ও পুরুষ হবে প্রকৃতই মুক্ত।
আমূল নারীবাদ-নারীপীড়নের সমস্ত দিক ব্যাখ্যা করে একটি মূল ধারণা দিয়ে, সেটি হচ্ছে লৈঙ্গিক পীড়ন। উদার নারীবাদীরা মনে করেন নারীর সমস্যা রাজনীতিক সামাজিক অধিকারহীনতা, কিন্তু আমূল নারীবাদীরা তা মনে করেন না । মার্ক্সীয়দের মতো তাঁরা মনে করেন না যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজই নারীর দুরবস্থার মূলে। তাঁরা মনে করেন নারীর দুরবস্থার মূল কারণ জৈবিক: গর্ভধারণ করতে গিয়েই নারী মেনে নিতে বাধ্য হয় পুরুষের অধীনতা। তাঁদের মতে পরিবারের উৎপত্তি ঘটেছে জৈবিক কারণে, পরিবার একটি জৈব সংগঠন। তাঁরা মনে করেন ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে আদি ও মৌলিক পীড়ন হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক শারীরিকভাবে নারীকে নিজের অধীনে নিয়ে আসা। তাঁরা যেনো মনে করেন যে দেহই নারীর নিয়তি। তবে নারীকে মুক্তি পেতে হবে এ নিয়তি থেকে। তাঁরা মনে করেন জৈব পরিবারে যে শক্তির সম্পর্ক দেখা দেয়, তাই শক্তির মৌল কাঠামো। তাঁদের মতে জৈব পরিবারই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মূলে। তাঁদের মতে পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গৌণ ব্যাপার, মূল লড়াই হচ্ছে লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। আমূল নারীবাদী ভাবনার উন্মেষ বোভোয়ার, মিলেট, গ্রিয়ার ও আরো অনেকের মধ্যে দেখা যায়, তবে তা প্রবল রূপ পায় টাইগ্রেস অ্যাটকিনসন ও শুলামিথ ফায়ারস্টোনের লেখায়। তাঁদের মতে নারী-অধীনতা মূলত জৈবিক, তাই নারীমুক্তির জন্যে দরকার জৈবিক বিপ্লব। তাঁরা মনে করেন মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম প্রযুক্তিবিদ্যার এমন উন্নতি হয়েছে যে তার সাহায্যে নারীকে মুক্ত করা সম্ভব সন্তান ধারণ ও পালনের মৌলিক অসাম্য থেকে। তাঁরা মনে করেন গর্ভধারণ নারীর জন্য অবধারিত নয়, মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়। যদি মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হয়, তবে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে পুরুষকেও। নারী আর গর্ভধারণ করবে না, শিশুপালন করবে না; কৃত্রিম উপায়ে জন্ম দিতে হবে সন্তান, আর সমাজ বহন করবে তার পালনের দায়িত্ব।
এ মৌলিক পরিবর্তনের সাথে রাজনীতিক, সামাজিক, অর্থনীতিক প্রভৃতি গৌণ ব্যাপারেও বদল ঘটাতে হবে; নারীকে দিতে হবে আত্মনিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ অধিকার। তাঁরা মনে করেন সমাজের সমস্ত কাজে নারীকে সম্পূর্ণরূপে জড়িত করতে হবে, এবং দিতে হবে যৌন স্বাধীনতা। পরকীয়া যৌন স্বাধীনতা নয়; তবে নারী মুক্তির অনুষঙ্গ উপাদান মাত্র। তাঁদের মতে প্রযুক্তি শুধু নারীকে গর্ভধারণের দায় থেকে মুক্তি দেবে না, পরিশেষে তা মুক্তি দেবে নারী-পুরুষ উভয়কেই কাজ করার দায় থেকে। প্রযুক্তি ধ্বংস ক’রে দেবে পরিবারের জৈবিক ও আর্থ ভিত্তি, বাতিল হয়ে যাবে পরিবার, নারীপুরুষের বিভিন্ন ভূমিকা ও শক্তির সম্পর্ক। তাঁরা মনে করেন নারীকে নিজের ভূমিকা বেছে নেয়ার অধিকার দেয়াই যথেষ্ট নয়; জৈবিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিলুপ্ত করে দিতে হবে সমস্ত ‘ভূমিকা’। তাঁদের মতে জৈবিক পরিবার বিলুপ্ত হলে যৌন নিপীড়নও নির্যাতন লোপ পাবে বলে মনে করা হয়। তখন কে কার সাথে ও কোন ধরনের যৌনসম্পর্কে জড়িত হবে, তা স্থির করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে প্রতিটি নরনারীর। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নারীর যে লড়াই,তা আর থাকবে না।তখন সমকাম-পুরুষের সাথে পুরুষের, নারীর সাথে নারীর-নিন্দিত থাকবে না, বিকল্প বলেও গণ্য হবে না; যে যার রুচি মতো বেছে নেবে বিশেষ ধরনের যৌন সম্পর্ক যেখানে ভালোলাগাটুকু কাজ করবে শক্তিশালীরুপে। উদার নারীবাদীদের মতে সমকাম, বিষমকামের বিকল্প, মার্ক্সীয়দের মতে সমকাম পুঁজিবাদী বিকৃতি; আমূল নারীবাদীদের মতে এটা স্বাভাবিক। তাঁদের মতে জৈবিক বিপ্লবের ফলে ‘সমকাম’, ‘বিষমকাম’ প্রভৃতি ধারণাই লোপ পাবে; লোপ পাবে ‘যৌনসঙ্গম’ নামের সংস্থাটিও, যাতে নারী-পুরুষ পালন করে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। সাম্য বলতে আমূলবাদীরা শুধু সুযোগসুবিধার সাম্য বোঝেন না, বোঝেন সন্তানধারণ না করারও সাম্য। তবে সন্তানকে ভালোবাসার অধিকার থাকবে উভয়ের। জৈবিক বিপ্লব বাস্তবায়িত হ’লে রাষ্ট্র লোপ পাবে; এর ফলে এমন মানুষ দেখা দেবে, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। এ-বিপ্লব শুধু নারীকে মুক্ত করবে না, মুক্ত করবে পুরুষকেও; পুরুষ মুক্তি পাবে ভরণপোষণের ভার থেকে, কিন্তু তারাও সন্তান ধারণ ও লালনে পালন করবে সমান দায়িত্ব।
আমূল নারীবাদের একটি ধারা হচ্ছে ‘নারীসমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদ’। তাঁদের মতে পুরুষাধিপত্য বিলুপ্ত করার উপায় হচ্ছে পুরুষের সাথে কোনো সম্পর্কে না আসা। তাঁদের একদলের মতে, এটা সাময়িক ব্যবস্থা; আরেক দলের মতে, এটা হবে সব সময়ের ব্যবস্থা। তাঁদের মতে কে কার যৌনসঙ্গী, এটা কোনো গুরুত্বের ব্যাপার নয়; তবে এখনকার পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজে যৌনসঙ্গী নির্বাচনও রাজনীতি। তাই, পুরুষাধিপত্য প্রতিরোধ করার জন্যে নারী পুরুষকে প্রত্যাখান করে যৌনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে নারীকে। তাঁদের মতে বিষমসম্পর্কের ভেতরেই গোপন রয়েছে এমন বিশ্বাস যে পুরুষ প্রভুত্ব করবে নারীর উপর। অনেক নারীসমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদী আবার প্রতিষ্ঠা করতে চান মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, কেননা তা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে উন্নত। যদিও সম-সাময়িককালে মার্ক্সীয় নারীবাদ কিছুটা ভিন্ন রূপ নিয়েছে, যা ধ্রুপদী মার্ক্সীয় নারীবাদের সাথে যুক্ত করেছে কিছু নতুনত্ব। তাঁরা সন্তানধারণে প্রস্তুত,এবং আমূল নারীবাদকে গণ্য করেন ইউটোপীয় ধারণা বলে। তাঁরা মনে করেন সাম্যবাদই নারীমুক্তির পূর্বশর্ত, তবে সাম্যবাদই যথেষ্ট নয়; কেননা সাম্যবাদী সমাজেও বিরাজ করতে পারে লিঙ্গবাদ। তাই নারীমুক্তির জন্যে বদলে দিতে হবে সামাজিক সম্পর্কের সম্পূর্ণ রূপটিকেই।
যে কামে নারীর ভূমিকা প্রধানতঃ সক্রিয় (বেভোয়ার ২০১২:২৪২)। কিন্তু রাধার বক্তব্য তা মনে হয়না বরং রাধা আক্রমনাত্মক আচরনে কৃষ্ণের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুখ পাওয়ার জন্য চায় একটু প্রণয় স্পর্শ, ঘটাতে চায় প্রেমের কিংবা রসের সম্মিলন। নারীকে অর্ন্তমূখি হলেই ভালো মানায় এমন বক্তব্যের দৃঢ় উচ্চারনে রাধা ইন্দ্রিয়ানুভূতির জগতে এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন তেজস্বী নারী, আক্রমনাত্মক, প্রাণোচ্ছল ও জীবন শক্তিসম্পন্ন এবং পৌরুষ শক্তি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যে দাবী করে যৌনতায় মুক্ত হবে নারী। বিমূর্ত এ নারীকে নিয়ে লেখার কাজ শুরু করেছেন অনেকেই , অনেক আগে থেকেই।
পরকীয়া প্রেমের একটি তাত্ত্বিক ও যৌক্তিক ভিত্তি আমরা বেভোয়ার (২০১:২৫৭) এ পাই। আমরা এটাকে পরিপূর্ণভাবে মেনে নিতে পারি না, তবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের শক্তিকে বুঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। বেভোয়ার মনে করেন, যেহেতু পুরুষটি গ্রহণ করে নারীটিকে, তাই তার পছন্দ-অপছন্দ করার যথেষ্ট কারণ থাকে। কারণ পাত্রীর সংখ্যা অজস্র। কিন্তু যৌন কর্মকে যেহেতু নারীর ওপর ন্যস্ত থাকে একটি সেবামূলক দায়িত্ব বলে এবং এ সেবার উপর ভিত্তি করে তাকে বা নারীটিকে দেয়া হয় সুযোগ সুবিধা, তাই এটা যুক্তি সঙ্গত যে, সে উপেক্ষা করবে তার ব্যক্তিগত বিশেষ অনুরাগগুলো।বিয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ হিসেবে নারীর স্বাধীনতা অস্বীকার করা; কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া যেহেতু প্রেমও থাকতে পারেনা; ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যও থাকতে পারেনা। তাই নিজের জন্য আজীবন কোনো একটি পুরুষের রক্ষণাবেক্ষণ লাভের ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্য তাকে ছেড়ে দিতে হয় একটি বিশেষ ব্যক্তির ভালোবাসা।” রাধা-কৃষ্ণ উভয়ে উভয়কে জানতো চিনতো ছোট বেলা থেকেই। উপকথা প্রচলিত যে, রাধাকে প্রথম প্রথম মনে করা হতো জন্মান্ধ। কৃষ্ণ যখন তার পালিত মাতার সাথে প্রথম রাধার বাসায় যান, তখনই সকলে খেয়াল করেন যে, রাধা সবকিছুই দেখছে। এবং তারা স্বত:স্ফুর্তভাবে খেলা করছে। তখন হতে মনে করা হয় যে, রাধা প্রথম দর্শনেই কৃষ্ণকে লাভ করে। তাই- আয়ান ঘোষ রাধার প্রেম হলেও হতে পারে কিন্তু কৃষ্ণ, ‘রাধার প্রথম ভালোবাসা’ দ্বিতীয়ত: প্রেম ও ভালোবাসা। অর্থ্যাৎ একটি মনোনীত সঙ্গীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন নারীর কাজ নয়, তার কাজ হচ্ছে সাধারণ ভাবে নারীধর্মী ভূমিকা পালন করা; তাকে কাম সুখ লাভ করতে হবে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট একটি রূপে, সেটা ব্যক্তিগত স্বভাবের হবে না। তার কাম নিয়তির আছে দুটি অপরিহার্য্য পরিণতি। প্রথমতঃ বিবাহবহির্ভূত কোনো যৌন কর্মকান্ডের অধিকার তার নেই; যৌনসঙ্গম এভাবে হয়ে ওঠে একটি সংস্থা, সমাজের স্বার্থের কাছে গৌণ হয়ে ওঠে দু’টি লিঙ্গেরই কামনা ও পরিতৃপ্তি; তবে কর্মী ও নাগরিক হিসেবে পুরুষ যেহেতু সর্বজনীনতার দিকে প্রসারিত, তাই সে বিয়ের আগে ও বিয়ের বাহিরে উপভোগ করতে পারে আকষ্মিক প্রমোদ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ-প্রথায় এ বিরোধীমূলক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ রাধা শুরু করেন যেখানেই নারীমুক্তির প্রথম সোপান বলে অযৌক্তিক মনে হবে না।
যৌনতা সম্পর্কিত নারীবাদ যেসব তাত্ত্বিকের তত্ত্ব বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। সেগুলো প্রধানতঃ দু’টি অংশে বিভাজন করা যায় -
ক. নারীবাদী যৌনতা- যা দিয়ে বিশেষ করে আজকের ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদেহ হয়ে উঠে ভোগ্য বস্তু; বাজার যৌন কামনাকে নিয়ন্ত্রন করে। এদুয়ের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে রাই বিনোদিনী চিরন্তনভাবে।
খ. মাতৃত্ব বিষয়ক একমাত্র সামাজিক ও প্রাকৃতিক সত্য। শুরু হতেই ব্যাখোফোনের মতো নৃবিজ্ঞানীরা মাতৃত্ব কল্পনা করেছিলেন। এ সকল নৃবিজ্ঞানীদের কাজে নিরিখেই এঙ্গেলস (২০১৪/১১ পুনঃমুদ্রন) পিতৃতান্ত্রিকতার আবির্ভাবকে বলেছিলেন নারীর বিশ্ব-ঐতিহাসিক পরাজয় হিসেবে যার কারনে রাধার পুনরৎপাদনের বিবরণ পাওয়া যায়না। এ পরাজয়ে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য বিস্তার করে যৌনতাকে রেখেছে দাসত্বশৃংখলে। রাধা এখানেই নারীবাদী হিসাবে অনন্য আজোও এ ধারার অগ্রপথিক। । ফলে প্রকৃত নারীবাদ সামনে আনতে হলে এর সামাজিক রূপটি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন যা শুরু করেছিলেন রাধা। রাধা মেয়েদের শরীর এবং যৌনতার ওপরে পুরুষের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যে দৃঢ় প্রতিবাদী উচ্চারণ করেছিলেন তা নারীবাদ বিনির্মাণের বিকল্প আছে বলে আপাততঃ মনে হয় না।