এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

প্রেম—পরকীয়ায় উপসংহার একটি আলু থালু অবস্থা

 

আমাদের মতো অগ্রসর সমাজ ব্যবস্থায় যৌন ও নারী সম্পর্কিত আলোচনা বাতুলতামাত্র এমনকি জ্ঞান জগতের শাখা-প্রশাখায়ও। অথচ এ সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে যৌনরোগ প্রকোপ বৃদ্ধির পাশাপাশি ফি বছর সন্তান পুনরৎপাদন আমাদের জনসংখ্যা ও সামাজিক সমস্যার সংখ্যাকে বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে ও বহুবিধভাবে। যাই হোক অঙ্গ কিংবা প্রজনন বা পুনরৎপাদন অথবা প্রেম-পরকীয়া সংক্রান্ত বিষয়ে উপসংহার টানা আমার জন্য মন্দোদরির ন্যায় অবস্থা। গল্পটি বলা যেতেই পারে-ত্রেতা যুগে রাম-রাবনের যুদ্ধে নিহত রাবনের স্ত্রী যখন স্বামী মৃত্যুর খবর পেলেন তখন কাঁদতে কাঁদতে অন্দরমহল হতে রাজ সভায় আসলেন। অতিমাত্রায় বিলাপে, তার অশ্রু জলে কেবল মুখমন্ডলই ভাসেনি বরং বুক চাপড়ানোর ফলে তার চুল হয়ে গেল আলু-থালু অবস্থা। উদ্‌ভ্রান্ত পথিক। যেন নিয়তির পথ হারিয়েছে। যদিও রাজ্য জয়ের পর রাম, বিভীষণকে রাজা বানালে, মন্দোদরি অর্থ্যাৎ দেবর-বৌদির বিয়ে দেন। (পাঠক না, ঐরকম সম্পর্ক তাদের মাঝে ছিলোনা)। প্রসঙ্গটি মন্দোদরির নয়, তাই রাই এর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যদি নারীটি প্রচলিত নিয়মের অনুগত হয়, তাহলে সে গ্রহণ করবে সতর্ক ও কেতাদুরস্ত ব্যক্তিত্ব। অথবা যদি নিয়ম ভাঙ্গার অগ্রযাত্রী হয়, পরিচিতি করে তোলে নিজেকে রহস্যময়ী, অকপট, উচ্ছ্বল, বেশ সাহসী, ইত্যাদি-ইত্যাদি। যদিও বলা হয় রাধিকা- একটি বিমূর্ত এবং হ্লাদিনী শক্তির প্রতীক। কিন্তু আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবিও বটে। যে ছবিটি আমরা দেখি প্রতিনিয়ত চলতে, ফিরতে। এই চলা-ফেরার মধ্যে দিয়ে যখন বিবাহ নামক সামাজিক সংস্থাটির বিবর্তনীয় রূপ এক পত্নী বিবাহ। এই এক পত্নী বিবাহ প্রথায় ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-দুইটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সামাজিক চরিত্র দেখতে পান। প্রথমতঃ স্ত্রীর প্রেমিক, দ্বিতীয়তঃ ব্যভিচারী স্ত্রীর স্বামী। এক পত্নীক বিয়ে ও বেশ্যাবৃত্তির সাথে, ব্যভিচার হয়ে ওঠে একটি অবধারিত সামাজিক সংস্থা, নিষিদ্ধ, কঠোর ভাবে দন্ডিত কিন্তু দমন অসম্ভব। কারন-বেভোয়ার উল্লেখ করেন (২০১২:২৯৬)-যদি দাম্পত্য শৃঙ্গার স্ত্রীটির ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির না ঘটিয়ে জাগিয়ে তোলে তার ঔৎসুক্য, তাহলে খুবই স্বাভাবিক যে সে তার পাঠ সমাপ্ত করবে অন্য কোন শয্যায় ভিন্ন কোন উপায়ে। তাছাড়াও পরিস্থিতি ও প্রথা অনুসারে এর ভিন্নমাত্রা, ও ভিন্ন কারনও পাওয়া যায়। তবে কারনই যাই হোক আমাদের সমাজে যেখানে টিকে আছে পিতৃতান্ত্রিক প্রথা, ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা, তাই বৈবাহিক অবিশ্বস্ততা আজো স্বামীর থেকে স্ত্রীর জন্যে অনেক বেশী, লজ্জার,কষ্টের কিংবা অপরাধের। রাধিকা একটি সম্পর্ককে উপস্থাপন করে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন? কারণ রাধা যৌনক্রিয়াকে কোনো ট্যাবুতে আটকে রাখতে চাননি, যৌন ট্যাবুই নারী মুক্তির ক্ষেত্রে একটি ঔদাসীন্য যে তৈরী করে তা বিদ্যাজগতের আলোচনায় প্রমাণিত। অথচ আমরা বেমালুম ভুলে যাই নারী মুক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর হয় কামের স্তরের স্বাধীনতা। এ স্তরে বেভোয়ার (২০১২:৩৩৯) মনে করেন যে, যৌনতার ব্যতিক্রম করে নারী তার প্রতিবাদের একটি দিক সমাজের চোখে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। কেননা,নারীর আচরণের বহু দিক আছে। যেগুলোকে আমরা প্রতিবাদের এক একটি রূপ হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে বেভোয়ার উল্লেখ করেছেন নারী প্রায়ই তার স্বামীর সঙ্গেঁ প্রতারণা করে প্রকাশ্যে অবাধ্যতা দেখিয়ে এবং তা সে করে উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই। আয়ান ঘোষের বাধ্যবাধকতা না মেনে চলতে চায়নি রাধা, তাই কৃষ্ণের সাথে সম্পর্ক তো ছিন্ন করেনি বরং হয়ে উঠেছে আরো প্রতিবাদমুখর, উন্মোচন করেছেন দাম্পত্য জীবনের নানা ফিরিস্তির কিস্তি। রাধার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে ছিল শ্যামের প্রতি ভালবাসা। আর তাইতো, সেই পুরুষের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকে, ভিতর-বাহিরের প্রবল অনুপস্থিতিই রাধার অঙ্গেঁ আগুন জ্বলে দমকে দমকে যা সে বলে সহাস্যরসে এক প্রতিবাদের কন্ঠ দিয়ে; যা আজকালকার নারীমুক্তির জন্য বেজায় মানানসই। কালার অনুপস্থিতি বা পলায়ন আপনি যাই বলুন- রাধা তা বুঝতে পারেনা সঙ্গত কারনেই। পুরুষের বিশ্বকে, নারী উপলব্ধি করতে পারেনা বলে বোদ্ধা মহল মনে করেন, কেননা তাদের অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করতে শেখায় না। ফলে, প্রবঞ্চনা ও প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে রাধার ন্যায় নারী, পুরুষের শিকার হয় যৌনতার কারনেই। নারী তার সত্তা দিয়ে যে অভিজ্ঞতা যাপন করে, সেখানে পুরুষ হয়ে উঠে অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়; আর ঐ খেলার মাঠে নারী বরাবরই কুপোকাত। না পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট খেলার ছক বা উপকরণ থাক বা না থাক, সমাজের চোখে সমস্যা হয় না। কারন তার আছে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে জমজমাট আসর, কিন্তু নারীর জন্য যতই যৌক্তিক কারণ থাকুক-সে ভরে থাকবে নির্দিষ্টতাবাদ এ যা ঐ ঐতিহাসিকও বটে। যাপিত জীবনে এরকম একটি ধর্মীয় গল্প পাওয়া যায়-পুরুষ ধর্মীয় বিধান মেনে চললে পর জগতে আঠারোটি সুন্দরী নারী পাবে সেবাদাসী হিসেবে। কিন্তু ঐ একই ধর্মীয় বিধান প্রতিপালন করার কারনে নারী পাবে কেবল তার স্বামীকে। অর্থ্যাৎ-মৃত্যু পরবর্তী যুগে তাকে ঊনিশ নারীর সাথে সংসার করতে হবে। ধর্মীয় এ বিধানের বিতর্ক এড়িয়ে বলা যায় নারী তার সীমাবদ্ধতার মাঝে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্টে এবং রাধার প্রতিবাদী আচরণ এ ক্ষেত্রে মোক্ষম অস্ত্র নয় কি? 

মনে হতে পারে খাপছাড়া কিংবা অপ্রাসঙ্গিকভাবে নারীবাদ ও যৌন অঙ্গের বর্ণনা কিন্তু যে অঙ্গের জ্বলুনি দিয়ে শুরু তার শেষ জানা ও জানানোটা লেখার দায় মনে করে সংযোজন করেছি রাষ্ট্র ও নারীবাদ সম্পর্কিত আলোচনাগুলো। যৌনতার জন্য রাষ্ট্রের দায় আছে ( পরিমল : ২০০৫)। এ দায়ের অস্বীকার বা স্বীকার যাই হোক না কেন সর্ন্তপনে না হাটঁলে বিপর্যয় আনে তুমুলভাবে। সমূলে বিনাশ হোক সমাজ বিধ্বংসের সকল বীজ ,  সম্প্রসারিত এমন ভাবনা থেকেই আলোচনার দ্বার উন্মোচনই এ লেখার উদ্দেশ্যও বটে।    


 

সূত্রের উৎস মুখ ও সংযোজিত ক্ষুদ্র কথা।

১. আজাদ, হুমায়ুন (২০১১.৩য় মুদ্রন) – নারী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা নারীবাদ এবং যৌনাঙ্গের বর্ণনা মূলতঃ আজাদ (২০১১) ও    

             পৃথ্বীরাজের (১৪০৭) গ্রণ্থ হতে নেওয়া হয়েছে এখান এসবের বর্ণনা অতুলনীয় এবং প্রাঞ্জল বলে।  কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। 

২. আহমেদ, শামীম (২০২০)- মহাভারতের যৌনতা, কবি প্রকাশনী, ঢাকা

৩. কবীর, বিলু (২০১৮) – বাঙ্গালির কুসংস্কার ও লোক-বিশ্বাস, জয়তী, ঢাকা।

৪. কবীর, বিলু (২০১৪)- ‘অশ্লীল’ লোক ছড়ায় সমাজ চিত্র, গতিধারা, ঢাকা।

৫. চৌধুরী, নীরদ চন্দ্র (১৪২৩ বঙ্গাব্দ) - বাঙ্গালী জীবনে রমনী ,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কোলকাতা, ভারত।

৬. চৌধুরী, নীরদ চন্দ্র (১৪২৩ বঙ্গাব্দ,৭ম মুদ্রন) -  আত্মঘাতি বাঙ্গালী ,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কোলকাতা, ভারত।

৭. চক্রবর্তী, সুধীর (সম্পাদিত:২০১০) - যৌনতা ও সংস্কৃতি, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা

৮. চট্টোপাধ্যায়, শরৎ -নারীর মূল্য, কথা প্রকাশ, ঢাকা কর্তৃক পুন: প্রকাশিত ২০০৮

৯. চৌধুরী, মানস(২০২০) - দৃশ্যগত নৃবিজ্ঞানঃ দৃশ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন, রাজশাহী। 

১০.চৌধুরী, মানস(২০০০)-সোনা বন্ধুর পিরীতি এবং ভালোবাসার সুশীল ডিসকোর্স,সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার।

১১. নিউটন, সেলিম রেজা (সম্পাদিত:২০১৫) -অভ্যাসের অন্ধকার, আগামী প্রকাশনী , ঢাকা।  

১২. রায়, পরিমল কুমার (২০০৫)–বিশ্বদ্যিালয়ে মাস্টার্সে উচ্চমার্গীয় পতিতা বা কলগার্ল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রাস্ট্র ও যৌনতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়। (Class  Strewed Prostitution : An anthropological exploration in frontier city of Bangladesh;  Dept. of Anthropology , SUST, Sylhet) 

১৩.বেভোয়ার, সিমোন দ্যা (১৯৪৯)- দ্বিতীয় লিঙ্গ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা অনুবাদ হুমায়ুন আজাদ (২০০১)।  

১৪. বর্মন, রেবতী (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)- সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশকথা প্রকাশ, ঢাকা

১৫. বসাক, ড: রাধা গোবিন্দ (১৯৫০:বঙ্গানুবাদকৃত)- কোটিলীয় অর্থশাস্ত্র (অখন্ড সংস্করণ), ভারত।

১৬. বসু, পূরবী (২০১৩) – প্রাচ্যে পুরাতন নারী,অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।

১৭. মঈন, রাবেয়া (১৯৮৯)- বক্ষ বন্দনা, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, ঢাকা

১৮. রায়,  নয়ন ও অনন্যা, অভয়া ( সম্পাদিত ১৪২৬ বঙ্গাব্দ)- দুই বাংলার পরকীয়া ( ১ম খণ্ড),  আকাশ. ঢাকা। 

১৯. সেন, পৃথ্বীরাজ ( সংকলিত: ১৪০৭ বঙ্গাব্দ) -বিশ্বের কামসূত্র সমগ্র , কামিনী প্রকাশালয়, কলিকাতা।

২০.হক, সৈয়দ শামসুল (২০১৯)- কানার হাট বাজার, ঐতিহ্য , ঢাকা।  

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই: